চিত্রসেন রায় : কীর্তিচাঁদের পুত্র চিত্রসেন। তিনিই প্রথম রাজ উপাধি লাভ করেন। সাল ১৭৪১। তখন মোগল সম্রাট ছিলেন মহম্মদ শাহ। সম্রাটের অনুমতি নিয়ে আরও কয়েকটি পরগনা তিনি দখল করেছিলেন। চিত্রসেনের সময় মণ্ডলঘাট, আরসা, চন্দ্রকোণার পুরোটা বর্ধমানের অধিকারভুক্ত হয়। যুদ্ধ করে বীরভূম, পঞ্চকোট ও বিষ্ণুপুরের অনেকটা তিনি দখল করে নেন। রাজগড়ে নির্মাণ করলেন প্রথম দুর্গ। দ্বিতীয় দুর্গ হল বীরভূমের প্রান্তে অজয়নদের তীরে–সেন পাহাড়ি। এই সময় বাংলায় ঘনিয়ে এসেছিল প্রবল দুর্দিন। একটি হল বর্গির হাঙ্গামা অপরটি ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। মহারাষ্ট্রের একদল নিষ্ঠুর লুঠেরা বাংলাদেশটাকে প্রায় শ্মশান করে দিয়েছিল। সাল ১৭৪৯। গ্রাম এবং শহর লুঠ করে, খুন করে, যে কোনও বাড়িতে ঢুকে যথাসর্বস্ব হরণ করে, ধানের গোলায় আগুন লাগিয়ে–এই বর্গিরা রঘুজি ভোঁসলের নেতৃত্বে তাণ্ডব শুরু করে দিয়েছিল। ভাবতে অবাক লাগে তাদের সঙ্গে ছিল প্রায় চল্লিশ হাজার অশ্বারোহী ফৌজ। ওড়িশা দিয়ে ঢুকে ছড়িয়ে পড়ত পঞ্চকোট, বিষ্ণুপুর, বীরভূম, মেদিনীপুর ও বর্ধমানে। এই সমগ্র এলাকাটা ছিল বারবার আক্রমণের লক্ষ্যস্থল। বর্ধমান জেলার কাটোয়া পর্যন্ত একটা জায়গাও তাদের আক্রমণের বাইরে রইল না। জমির সমস্ত ফসলই শুধু নষ্ট করল না উর্বরতাও শেষ করে দিল। বর্ধমানের শস্য ভান্ডার শেষ। বাইরে থেকে আনার পথও বন্ধ। অনাহারে প্রাণ যায়। মানুষ গাছের পাতা ও শেকড় খেতে শুরু করল। তাও একদিন শেষ হয়ে গেল। বর্গির হামলার যদি একটি মানচিত্র আঁকা যায় তাহলে দেখা যাবে–ওদিকে রাজমহল, এদিকে মেদিনীপুর ও জলেশ্বর পর্যন্ত সুবিস্তৃত একটি অঞ্চল বর্গির আক্রমণে প্রায় ধ্বংস। তাঁদের নিষ্ঠুরতার কোনও তুলনা ছিল না। মানুষের নাক, কান কাটছে, এমনকী হাত দুটোও উড়িয়ে দিচ্ছে। সমস্ত মৃতদেহ ফেলা হচ্ছে নদীর জলে। এক-একটি হত্যাকাণ্ডের এক-এক পদ্ধতি। কারও গলায় ময়লা ভর্তি বস্তা বেঁধে, হাত-পা কেটে জলে ফেলে দিল। কারওকে জীবন্ত পুড়িয়ে ছাই করে দিল। গঙ্গারামের মহারাষ্ট্র পুরাণে প্রত্যক্ষ একটি বর্ণনা আছে।
তবে সব বরগি গ্রাম লুটতে লাগিল
যত গ্রামের লোক সব পলাইল।
ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পলায় পুঁথির ভার লইয়া
সোনার বাহনা পলায় সোনার ভার লইয়া।
গন্ধবণিক পলায় দোকান লইয়া যত
তামা পিতল লইয়া কাঁসারি পলায় কত।
শঙ্খ বণিক পলায় করাত লইয়া যত।
চতুর্দিকে লোক পলায় কি বলিব কত।
নবাব আলিবর্দির চেষ্টায় বর্গিরা কিছুটা পিছু হটলেও নবাবকে কাটোয়া দুর্গে আশ্রয় নিতে হল। ১৭৪২ সালে কাটোয়ায় দু-পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হল। ভাস্কর পণ্ডিত পরাজিত হয়ে পঞ্চকোটের দিকে পালিয়ে গেল। কিছু পরে শক্তিসঞ্চয় করে চন্দ্রকোণার ভেতর দিয়ে। মেদিনীপুরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অবশেষে আলিবর্দি তাদের সঙ্গে সন্ধি করলেন। সন্ধির চুক্তি অনুসারে কটকশহরটি ছেড়ে দিতে হল। আর বছরে বারো লাখ টাকা চৌথ হিসাবে। মারাঠাদের অর্থকোষে জমা দেওয়ার শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হলেন নবাব। সেইসময় ছেলেদের ঘুম পাড়াবার সময় মায়েরা ঘরে ঘরে সুর করে বলতেন–
ছেলে ঘুমাল পাড়া জুড়াল
বর্গি এল দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে।
এই ডামাডোলের সময়েই মহারাজ তিলকচাঁদ মূলাজোড়ের কাছে কাউগাছিতে রাজধানী সরিয়ে এনেছিলেন। সে কথা পূর্বেই বলা হয়েছে।
এইখানেই সেই ঘটনাটি মূল কাহিনির সঙ্গে জোড়া লাগল।
রাজা চিত্রসেনের কোনও সন্তানাদি ছিল না। তিনি পরলোকগমন করার পর বর্ধমান রাজপরিবার ভিন্ন শাখায় চলে গেল। তাঁর পিতৃব্যপুত্র তিলকচাঁদ ক্ষমতায় এলেন। তাঁর ভাগ্য অতি প্রসন্ন। মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ১৭৬৪ সালে তাঁকে রাজবাহাদুর করে চার হাজার পদাতিক ও দু-হাজার অশ্বারোহী রাখার অনুমতি দিলেন। চার বছর পরেই ১৭৬৮ সালে তিনি হলেন মহারাজাধিরাজ, হয়ে গেলেন পাঁচ হাজারি মনসবদার। তাঁর বাহিনীতে আরও তিন হাজার অশ্বারোহী যুক্ত হল। কামান ও বন্দুকের শক্তিও পেলেন। সেই সময় বাংলায় ইংরেজ শক্তি প্রবল হচ্ছে। তখন বড় পিচ্ছিল অবস্থা। ১৭৬০ সালে তিলকচাঁদ ও বীরভূমের রাজা আসাদউল্লাহ একত্রিত হয়ে ক্যাপ্টেন হোয়াইটকে পরাজিত করলেন। এই বছরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৭৫৬ সালে আলিবর্দি চলে গেলেন পরলোকে। আর তার এক বছরের মধ্যেই পলাশি। বাংলা পরাধীন হল। মিরজাফর নামেমাত্র নবাব। প্রকৃত প্রভু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। অতি সমৃদ্ধ বর্ধমান কোম্পানির দখলে চলে গেল। কিন্তু তাঁরা তিলকচাঁদকে বন্ধু হিসাবেই গ্রহণ করলেন। একসময় মীরজাফরকেও যেতে হল। ১৭৬০ সালে মীরকাশেমকে বসানো হল মসনদে। তিনি বর্ধমানের রাজস্ব ধার্য করলেন। ৩১,৭৫,৪০৬ সিক্কা। এই কর দেওয়ার সংগতি মহারাজ তিলকচাঁদের ছিল না। মারাঠারা সব শেষ করে দিয়ে গেছে। মহারাজা উঁকিলের মাধ্যমে রাজ্যের অবস্থা কোম্পানিকে জানালেন। বর্গির হাঙ্গামায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় আট লাখ টাকা। রাজস্ব কিছুই আদায় হয়নি। কোম্পানি একটি সমঝোতায় এলেন। রাজস্বের পরিমাণ দাঁড়াল এগারো লক্ষ টাকা। কিস্তিতে কিস্তিতে দিতে হবে। তিলকচাঁদের পক্ষে দায়পরিশোধ করা সম্ভবপর হয়নি। ঠিক সেই সময় বীরভূম আর মেদিনীপুরে কোম্পানি বিরুদ্ধে সেখানকার রাজারা বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। তখন ইংরেজ কোম্পানি কোনও উপায় না দেখে বর্ধমানের মহারাজাকে মিত্র হিসেবেই গণ্য করলেন। রাজস্ব আদায় করার জন্য ১৭৬১ সালে বর্ধমানে একজন রেসিডেন্ট নিযুক্ত করলেন। এতেও কোনও সুরাহা হল না। রাজস্ব বাবদ প্রায় ছাব্বিশ লক্ষ টাকা বকেয়াই রয়ে গেল। তখন বর্ধমান মহারাজার কিছু কিছু জমিদারি হাতছাড়া হয়ে গেল। এর ফলে হুগলি ও বর্ধমানে নতুন একদল জমিদারের আবির্ভাব হল।