কৃষ্ণরাম রায় : ঘনশ্যাম রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র কৃষ্ণরাম রায় ঔরঙ্গজেবের ফরমান অনুসারে ১৬৮৯ সালে বর্ধমানের জমিদারি ও চৌধুরিপদে উত্তরাধিকারী হলেন। তিনি একটি বিশাল দিঘি খনন করালেন। নাম হল কৃষ্ণসায়র। সেইসময় মুদ্রা হিসেবে প্রচলিত ছিল কড়ি। এই বিশাল দিঘিটি খনন করতে প্রচুর কড়ি লেগেছিল। এটি বর্তমানে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি।
১৬৯৬ সাল। বর্ধমান রাজপরিবারের পক্ষে খুবই খারাপ সময়। ওই সময় চিতুয়া ও বরদার জমিদার শোভা সিংহ আর আফগান সরদার রহিম খাঁ একত্রিত হয়ে ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। মোগলদের প্রিয় ও আশ্রিত কৃষ্ণরাম রায় প্রাণ হারালেন। বর্ধমানের বহু এলাকা বিদ্রোহীদের দখলে চলে গেল।
পূর্বপুরুষদের কুলদেবতা লক্ষ্মীনারায়ণকে বৈকুণ্ঠপুর থেকে এনে বর্ধমানে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন আবু রায়। কৃষ্ণরাম রায় সেই বিগ্রহকে সরিয়ে এনেছিলেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরে। বিদ্রোহীরা এই কুলদেবতাকেই শুধু নয়, শিবমঙ্গল কাব্যের কবি রামকৃষ্ণ রায়ের গৃহদেবতা রাধাবল্লভকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। এই রাধাবল্লভকেও একসময় উদ্ধার করেছিলেন কৃষ্ণরাম। এই হামলায় দুটি বিগ্রহই বিধর্মীদের হাতে চলে গেল।
জগৎরাম রায় : ১৬৯৬ সালের জানুয়ারি। কৃষ্ণরাম ওইদিন নিহত হয়েছেন। রাজবাড়ি বিদ্রোহীদের কবলে। পুত্র জগৎরাম গা ঢাকা দিয়ে পালালেন ঢাকায়। শোভা সিংহ রাজপরিবারের মহিলাদের বন্দি করল। তার নজর পড়ল রূপসী রাজকুমারী সত্যবতীর ওপর। এক রাতে শোভা সিংহ রাজকুমারীর সম্ভ্রম নষ্ট করার চেষ্টা করল। বীরাঙ্গনা সত্যবতী তাঁর ঘাগরার মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন একটি ছুরি। সেই অস্ত্র বসিয়ে দিলেন লম্পট শোভা সিংহের বুকে। শোভা সিংহের জীবন এইভাবেই শেষ হল। রইল রহিম খাঁ। সে এইবার। বিদ্রোহ পরিচালনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিল। ওদিকে ওড়িশা, এদিকে হুগলি, মাঝখানে বর্ধমান। চতুর্দিকে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ল। লুঠপাট, নারীদের সম্ভ্রম নষ্ট ইত্যাদি যত অনাচার আছে সবই এত উদগ্র হল যে জনজীবন বিপর্যস্ত। ঔরঙ্গজেব তাঁর পৌত্র আজিম-উশ-শানকে। বিদ্রোহ দমন করার জন্য বাংলার সুবেদার নিযুক্ত করে বর্ধমানে পাঠালেন। ওদিকে ঢাকার নবাবপুত্র জবরদস্ত খান এই বিদ্রোহ দমনে জগৎরামকে নানাভাবে সাহায্য করতে লাগলেন। উভয়ের সমবেত চেষ্টায় বিদ্রোহীরা জব্দ হল। জগঞ্জামের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে বাদশাহ তাঁকে ফরমান দিয়ে সম্মান জানালেন। বর্ধমানের উপকণ্ঠে আজিমের কাছে বিদ্রোহীরা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হল। জগৎরাম শুধু তাঁর জমিদারি ফিরে পেলেন না, তার আয়তনও বেড়ে গেল। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই, ১৭০২ সালে জগৎরাম আততায়ীর হাতে প্রাণ হারালেন। পুত্র কীর্তিচাঁদ উত্তরাধিকারী হলেন। এই রাজবংশে কীর্তিচাঁদ এক উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি। যদিও রাজা উপাধিতে তিনি ভূষিত হননি।
রাজকুমারী সত্যবতী তাঁর সতীত্ব রক্ষার জন্য সুকৌশলে শোভা সিংহকে হত্যা করেছিলেন। সেদিন সত্যবতী ছাড়া রাজপুরীর দশজন সধবা ও তিনজন বিধবা হীরে চিবিয়ে আত্মবিসর্জন দিয়েছিলেন। রাজবাড়ির ইতিহাসে এই দিনটি চিহ্নিত হয়েছে জহুরীতিথি হিসেবে। যাঁরা প্রাণ দিলেন তাঁদের বলা হয় জহুরি। কারণ অমূল্য রত্ন হীরা তাঁদের রক্ষা করেছিল। রাজ ইতিহাসে জহুরিদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। তাঁরা হলেন –১) কুণ্ডুদেবী, ২) হোতা দেবী, ৩) চিমো দেবী, ৪) লক্ষ্মী দেবী, ৫) আনন্দ দেবী, ৬) কিশোরী দেবী, ৭) কুঞ্জ দেবী, ৮) জিতু দেবী, ৯) মূলক দেবী, ১০) দাসো দেবী, ১১) লাজো দেবী, ১২) পাতো দেবী, ১৩) কৃষ্ণা দেবী।
কীর্তিচাঁদ রায় : জগৎরামের দুই ছেলে–কীর্তিচাঁদ আর মিত্র রাম। পিতার মৃত্যুর পর কীর্তিচাঁদ ক্ষমতায় এলেন। নানা কারণে কীর্তিচাঁদ এক অসাধারণ ব্যক্তি। যেমন সুন্দর দেখতে সেইরকম আজানুলম্বিত বাহু। সবাই বলতেন, ইনি শাপভ্রষ্ট অর্জন। এই পরিবারে তিনিই ছিলেন অমিতশক্তিশালী এক যোদ্ধা। তাঁর লেফটেনান্ট কর্নেল ছিলেন–বৎস রাম খান্না। বর্ধমান রাজের সঙ্গে অন্যান্য জেলার যুদ্ধও হত। কীর্তিচাঁদ চন্দ্রকোণা (মেদিনীপুর) এবং বরদা (ঘাটাল) জয় করতে চলেছেন। তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে। পূর্বপুরুষ আবু রায় বর্ধমানের কাঞ্চননগরে রথতলার প্রতিষ্ঠাতা। সেই জায়গায় এক সাধু দিনরাত ধুনি জ্বালিয়ে বসে থাকতেন। তিনি কীর্তিচাঁদের যুদ্ধযাত্রা দেখে বলে উঠলেন, মহারাজের জয় হোক। কীর্তিচাঁদ থমকে দাঁড়ালেন। সাধুজিকে বললেন, আমি যতদিন না ফিরি ততদিন আপনি এখানেই থাকবেন। রাজকর্মচারীদের বলে পাঠালেন, মাথার ওপর সুন্দর একটি আচ্ছাদন তৈরি করে দাও আর রাজপ্রাসাদ থেকে প্রতিদিন যেন সেবা আসে।
যুদ্ধজয় করে কীর্তিচাঁদ ফিরে এলেন। সন্ন্যাসীকে পাঁচশো বিঘা নিষ্কর সম্পত্তি দান করলেন। তৈরি করে দিলেন বিশাল একটি মন্দির ও প্রাসাদ। পরবর্তীকালে এই সাধুই রাজগঞ্জের নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের আদি পুরুষ বলে সর্বত্র পরিচিতি পেলেন। কীর্তিচাঁদ অনেক ছোট ছোট রাজ্য জয় করে তাঁর নামের সার্থকতা প্রতিপন্ন করেন। চন্দ্রকোণা জয় করার পর রথযাত্রার দিন প্রকাশিত হয় কীর্তিচাঁদ রথ। প্রচুর ধূমধাম। সপ্তাহব্যাপী মেলা, কীর্তিচাঁদ রথে তাঁর বিজয় ঘোষণা। এই উৎসব স্থায়ী হল কাল থেকে কালান্তরে। তাঁর জয়গানে কবিরা মুখর হলেন, যদিও তিনি রাজা বা মহারাজা উপাধি পাননি, কিন্তু সেই সাধু তাঁকে মহারাজ বলেই সম্বোধন করেছিলেন। তাঁর সময়ে জমিদারির সীমা প্রসারিত হয়েছিল। বিষ্ণুপুরের রাজারা তাঁর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। চন্দ্রকোণার রাজা মোগল সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে শোভা সিংহের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। কীর্তিচাঁদ তাঁকেও শেষ করলেন।