সেকালে দাস বাঙালির স্বভাবই ছিল সাহেব দেখলেই পায়ের কাছে হামাগুড়ি দেওয়া। পদলেহন করে নিজেদের অবস্থা ফেরানো। এই দাস মনোভাব থেকে মুক্তি পেতে একযুগ সময় লেগেছিল। দক্ষিণারঞ্জনের পর বাঙালি সমাজ যে সন্ন্যাসীর সিংহগর্জন শুনেছিলেন তাঁর নাম স্বামী বিবেকানন্দ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও গর্জনকারী এক বাঙালি।
৪. বর্ধমানের রাজপরিবারের অভ্যুত্থান অলৌকিক
বসন্তকুমারী : বর্ধমানের রাজপরিবারের অভ্যুত্থান অলৌকিক। অনেকটা ইংরেজিতে যেমন বলে–From rags to reiches ছিল চটে শুয়ে, বসল গিয়ে সিংহাসনে। একে মিরাকল বলা যাবে না, সৎ প্রচেষ্ঠা এবং ভাগ্যের সংযোগ। মহামতী আকবর দিল্লির সিংহাসনে। স্বামীজি যে মোগলকে সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করতেন তিনি আকবর। ইংরেজরা আকবরকেই। বলেছেন–দ্য গ্রেট মোগল। ১৫৭৪ সালের বাংলা। শূর বংশের পাঠানদের রাজত্বকাল শেষ হওয়ার পর কররানি বংশের সুলেমান কররানি বাংলার সুলতান হয়েছিলেন ১৫৬৫ সালে। এই সুলেমান আকবরের শাসন কর্তৃত্বকে অস্বীকার করেননি। ফলে কোনও সমস্যার সৃষ্টি হয়নি। ১৫৭২ সালে তাঁর মৃত্যু হল। কনিষ্ঠপুত্র দাউদ খান সিংহাসনে বসলেন। সিংহাসনে বসেই মনে করলেন, আমি একটা কেউকেটা। দিল্লি অনেক দূরে। এই বাংলায় তারা দাঁত ফোঁটাতে আসবে না। সিংহাসনে বসেই তিনি এমন কয়েকটি কাজ করলেন যার ফল হল ভয়ংকর। প্রথম, নিজের নামে খুত বা পাঠ। দ্বিতীয়, নিজের নামে মুদ্রাও চালু করলেন। দিল্লির সিংহাসনে আকবর নড়ে বসলেন। তাঁর সুদক্ষ সেনাপতি মুনিম খাঁকে বাংলায় পাঠালেন। দাউদ খানকে ঢিট করতে। ১৫৭৬ সালের জুলাই মাস। রাজমহলের যুদ্ধক্ষেত্রে দাউদ খান মোগল সেনাদের মুখোমুখি হলেন। যথারীতি যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত। দাউদ খানের পরিবারবর্গ তখন বর্ধমান শহরে। তাঁরা বন্দি হলেন। রাজা টোডরমল বর্ধমান শহরেই ঘাঁটি গাড়লেন।
এরপরের দশ বছর দাউদের পুত্র কতলু খান বা কুট্টি খান আকবর বাদশার সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে চুক্তি অনুসারে কাজ করায় কোনও গোলযোগ নতুন করে তৈরি হয়নি। ওদিকে দিল্লির মসনদে পরিবর্তন দেখা দিল। আকবর প্রয়াত, সিংহাসনে জাহাঙ্গির। বাংলাদেশে আবার। বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিল। ১৬২৪ খ্রিস্টাব্দ। যুবরাজ খুররাম, পরে দিল্লির বাদশাহ হয়ে শাহজাহান নামে পরিচিত হল। তিনি গড়ের দুর্গ এবং বর্ধমান শহর দখল করলেন। সেই সময় পাঞ্জাবের অন্তর্গত লাহোর কোটালির কাপুর ক্ষত্রিয় আবু রায় ভাগ্যের সন্ধানে মাতৃভূমি ছেড়ে চলে আসেন বর্ধমানে। শুরু করেন চিরস্থায়ী বসবাস। বর্ধমান রাজের প্রতিষ্ঠা শুরু হল। বলা চলে। পরবর্তীকালে মহারাজাধিরাজ বিজয়চাঁদ মোগল বাদশাহ শাহজাহানের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা জানালেন এইভাবে, আমি তাঁর কাছে ঋণী। কারণ তাঁর ঔদার্যে আমি এই জমিদারির মালিক হয়েছি। অবশ্যই উপযুক্ত জমিদার। তা না হলে সারা ভারতে মহারাজাধিরাজ বর্ধমান সর্বশ্রেষ্ঠ জমিদার হিসাবে স্বীকৃতি পেতেন না। দিল্লির কোষাগারে সবচেয়ে বেশি খাজনা জমা পড়ত বর্ধমান রাজের।
সঙ্গম রায় : বর্ধমান অঞ্চলের ক্ষত্রিয়দের আদি পুরুষ আর বর্ধমান রাজবংশের প্রথম রাজা। লাহোরের কোটলে মহল্লার অধিবাসী। তিনি শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবকে দর্শন করার জন্য পুরীতে আসেন। সেখান থেকে ফেরার সময় বর্ধমান শহরের কাছে বোলেরা বৈকুণ্ঠপুর অঞ্চলটি ভালো লেগে যায়। সেখানেই বসবাস শুরু করলেন। তিনি ছিলেন শিবভক্ত। প্রথমেই একটি শিবমন্দির স্থাপন করলেন যা আজও আছে। শের আফগানের সঙ্গে জাহাঙ্গিরের ভাই। কুতুবউদ্দিনের যুদ্ধের সময় সঙ্গম রায় বাদশাহি সৈন্যদের রসদদার হলেন। তাঁর কাজে অত্যন্ত খুশি হয়ে বাদশাহ তাঁকে করে দিলেন চারহাজারি মনসবদার। হয়ে উঠলেন বর্ধমান অঞ্চলের একজন ধনী সওদাগর। বৈকুণ্ঠপুরে একটি নদী আছে বলুকা। নদীটি এখন শুকিয়ে গেছে। এই নদীর ধারেই সঙ্গম রায়ের বাসভবন ছিল।
বন্ধুবিহারী রায় : সঙ্গম রায়ের পরলোকগমনের পর পুত্র বন্ধুবিহারী বর্ধমানের ফৌজদারের অধীনে বর্ধমান চাকলার মুনসেফদারি পেলেন। এই রায় বংশ দিল্লির সম্রাটের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। বিপদে আপদে তাঁদের প্রচুর সাহায্য করতেন। এরই ফলে তাঁকে দেওয়া হয় রায়রায়ান উপাধি।
আবুরাম রায় : রায়রায়ান বন্ধুবিহারীর মৃত্যুর পর আবুরাম রায় বর্ধমান শহরের রেকাবিবাজার ও মোগল টুলির কোতোয়াল ও চৌধুরীপদ পেলেন জায়গির সহ। তিনি ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বর্ধমানে চলে এলেন। দিল্লির সিংহাসনে তখন সম্রাট শাহজাহান। বর্ধমান রাজবংশের প্রকৃত আদি পুরুষ আবু রায়। বর্ধমান শহরের পশ্চিমদিকে কাঞ্চননগরে বারোদুয়ারি নামে একটি বসতবাটি নির্মাণ করালেন।
বাবুরাম রায় : আবুরাম রায়ের মৃত্যুর পর বাবুরাম রায় হলেন উত্তরাধিকারী। খুব অল্পদিনই জীবিত ছিলেন।
ঘনশ্যাম রায় : বাবুরামের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ঘনশ্যাম বর্ধমানের কোতোয়াল হলেন। এই প্রথম শুরু হল প্রজাদের সেবা। শহরবাসীর জলকষ্ট দূর করার জন্য একটি বিরাট জলাশয় খনন করালেন। যার নাম শ্যামসায়র। এই অঞ্চলটি এখন খুবই উন্নত। পশ্চিমদিকে আধুনিক যুগের সমস্ত সুবিধাযুক্ত মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল, বিজয়চাঁদ দাঁতব্য। চিকিৎসালয়, বর্ধমান রায় কলেজ। সায়রের চারপাশে অতি সুন্দর শান বাঁধানো ঘাট। পূর্বদক্ষিণ কোণে হরিসভা, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, বর্ধমান শাখা। ঈশানেশ্বর শিবমন্দির। (জনশ্রুতি ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ এই মন্দিরে পূজা করেছিলেন), শ্রী রামকৃষ্ণ আশ্রম। সায়রের দক্ষিণে হরিসভা গার্লস স্কুল। এইসব জায়গা বর্ধমান রাজ পরিবারের দান।