সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা রাজনীতির আখড়া ছিল না কিন্তু রাজনীতির একটি অস্ত্র মাত্র। আসল উদ্দেশ্য দেশের প্রকৃত উন্নতি। আর সেই কাজের জন্য রাজনীতিতে রূপান্তর আনা প্রয়োজন। অতএব আলাদা একটি রাজনীতিক সভার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ১৮৪৩ সালের ২০ এপ্রিল টমসনের সভাপতিত্বে বালাখানায় একটি সভা হল। সেই সভায় বলা হল, এইরকম একটি সভার প্রয়োজনের কথা। সদস্যরা সকলেই একমত হলেন। ওই দিনই জ্ঞানোপার্জিকা সভার অবসান ঘটল। প্রতিষ্ঠিত হল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি।। যার মূল লক্ষ্য হল রাজনীতি। দক্ষিণারঞ্জন কার্যনির্বাহক সমিতির একজন উৎসাহী সদস্য হয়ে উঠলেন। সভাপতি ছিলেন জর্জ টমসন। সম্পাদক প্যারীচাঁদ মিত্র, কোষাধ্যক্ষ রামগোপাল ঘোষ। সদস্যদের মধ্যে অনেক ইংরেজ ছিলেন, যেমন–জি এফ রেমফ্রি, জি টি এফ স্পিড, এম ক্রো, অন্যান্য সবাই বাঙালি। একটি মুখপত্রও প্রকাশিত হল–বেঙ্গল স্পেক্টেটর। ১৮৪২ সালের এপ্রিল মাস থেকে মাসিকপত্র রূপে প্রকাশিত হতে লাগল। প্রবর্তক। রামগোপাল ঘোষ, প্রধান সম্পাদক প্যারীচাঁদ মিত্র। পত্রিকাটি বাইলিঙ্গুয়াল। ইংরেজি ও বাংলা তিনমাস পরে হল পাক্ষিক। কয়েকমাস পরেই হল সাপ্তাহিক। দক্ষিণারঞ্জন সম্পাদকীয় স্তম্ভে অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। কিছুকাল প্রধান সম্পাদকও ছিলেন। এই কাগজটির প্রচার ও প্রতিপত্তি হয়ে উঠল অসামান্য। জর্জ টমসন এই পত্রিকাটি প্রকাশের জন্য প্রচুর টাকা দিয়েছিলেন। এত প্রচার সত্বেও হিসাব করতে বসে দেখা গেল এক বছরে প্রায় এক হাজার টাকা লোকসান হয়েছে। শেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হল ১৮৪৩ সালের নভেম্বর মাসে। তারপরে উঠে গেল।
কলকাতায় সেকালে ধনী বড়লোকের ছেলেরা প্রভূত বিষয় সম্পত্তির অধিকারী হয়ে দুহাতে টাকা ওড়াতে ওড়াতে একসময় পথে বসত। এদের বলা হত কলকাতার বাবু। কোঁচানো ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি, কানে আতর, দু-ঘোড়ায় টানা ফিটন গাড়ি। রাত কাটত বাইজি মহল্লায়। দক্ষিণারঞ্জন অল্পবয়সেই ঠাকুরবাড়ির প্রচুর সম্পত্তি, অর্থ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন শিক্ষিত। ডিরোজিওর ইয়ং বেঙ্গলের একজন। তাঁর চরিত্র সম্পূর্ণ অন্যখাতে প্রবাহিত। নিজের ভোগসুখ নয়, দেশের মানুষকে শিক্ষার পথে, জাগরণের পথে, স্বদেশ চেতনার পথে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ব্রতী হয়েছিলেন। মনে প্রাণে তিনি ছিলেন। স্বাধীন। কোনও মত ও পথের দাসত্ব করা তাঁর স্বভাবে ছিল না। একটি ঘটনা তাঁর এই স্বভাবের পরিচয় বহন করছে। এখন যেখানে রাইটার্স বিল্ডিং ঠিক সেই জায়গার গোপীমোহন ঠাকুরের বিশাল একটি বাড়ি ছিল। সেকালে যেসব সাহেব নবীন সিভিলিয়ান হয়ে এদেশে আসতেন তাঁরা এই বাড়িটি ভাড়া নিয়ে বসবাস করতেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপকরা তাঁদের দেশীয় ভাষা, ইতিহাস, সামাজিক প্রথা ইত্যাদি শেখাতে আসতেন। এই দেশের কাজের উপযোগী হলে তাঁদের পোস্টিংহত বিভিন্ন পদে। আশপাশে দেশীয় মানুষের ঘরবাড়িও ছিল। সে সময় সকলের বাড়িতে গরু থাকত। একদিন একটি গাভি কোনওভাবে এই সিভিলিয়ানদের বসতবাটিতে ঢুকে পড়েছিল। একটি কমবয়সি সাহেব ছোঁকরা বাগানের গেট বন্ধ করে তার পোষা কয়েকটি কুকুরকে লেলিয়ে দিল। কুকুরের দল সেই গাভিটিকে আক্রমণ করে ছোটাছুটি করাতে লাগল। তার আর্তচিৎকারে ভাবী সিভিলিয়ানের খুব আনন্দ। গাভিটি প্রাণভয়ে ছুটছে আর সাহেবের পোষা কুকুররা তাকে ক্ষতবিক্ষত করছে। এইভাবে আর কিছুক্ষণ চললে গোরুটি প্রাণ হারাত। হিন্দু প্রতিবেশীরা আর্তনাদ শুনে ছুটে এসেছেন, কিন্তু কীভাবে গোরুটির প্রাণ বাঁচাবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না। পরিস্থিতি যখন চরমে উঠেছে ঠিক সেইসময় দেখা গেল একটি পালকি আসছে। পালকিটি ওই বাড়িটির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় এই গোলযোগ দেখে থেমে পড়ল। পালকিতে বসেছিলেন স্বয়ং গোপীমোহন ঠাকুর। তিনি নেমে এসে সিংহদরজা ভেঙে বাড়িতে প্রবেশ করলেন। হাতের ছড়ি দিয়ে ওই সাহেব যুবকটিকে উত্তমমধ্যম প্রহার। একবারও ভাবলেন না সাদা চামড়ার গায়ে হাত তুললে কী হতে পারে! এই গোপীমোহনের স্পিরিট দক্ষিণারঞ্জনের শরীরে প্রবেশ করেছিল। বেশ কিছুদিন পরে এই সিভিলিয়ানটি সদর আদালতের বিচারপতি হলেন। দক্ষিণারঞ্জনও তখন সদর আদালতের একজন আইনজীবী। একদিন ওই বিচারপতির এজলাসে একটি মামলায় দক্ষিণারঞ্জন উপস্থিত। তিনি তাঁর মক্কেলের হয়ে সওয়াল করছেন, প্রয়োজনীয় বক্তৃতা দিচ্ছেন। বিচারপতি দক্ষিণারঞ্জনকে উদ্দেশ্য করে কয়েকটি রূঢ় মন্তব্য করলেন। সেদিনের কথা, সেই প্রহারের কথা তিনি ভোলেননি। দক্ষিণারঞ্জন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আপনি এজলাসে বসে আছেন, বিচারকের আসনে। আপনার এই মন্তব্যের উত্তর আমি এখানে দিতে পারব না। তবে একসময় আপনি আদালত ছেড়ে বাইরে আসবেন তখন। এর উপযুক্ত জবাব পাবেন। দক্ষিণারঞ্জন এই কথা বলে কোর্টরুমের বাইরে চলে গেলেন। বিচারক এজলাস শেষ হওয়ার পর রাস্তায় বেরতে ভয় পাচ্ছেন। দক্ষিণারঞ্জন যথোচিত জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। জজ সাহেব এও জানেন দক্ষিণারঞ্জন গোপীমোহন ঠাকুরের পৌত্র। তখন তিনি দ্বারকানাথ ঠাকুরকে ডেকে দক্ষিণারঞ্জনকে শান্ত করার অনুরোধ জানালেন। দ্বারকানাথ আদালতের বাইরে এসে ক্ষিপ্ত দক্ষিণারঞ্জনকে অনেক বুঝিয়ে শান্ত করলেন। এই ছিল দক্ষিণারঞ্জনের স্পিরিট।