এই সময় দেশের রাজনীতিতে একটি চাঞ্চল্য আসছে। ভারতীয়রা ক্রমশই সচেতন হচ্ছেন। পরবর্তীকালে যা পরিণত হয় স্বাধীনতা আন্দোলনে। ১৮২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি ঘটনা ঘটল। প্রিন্স দ্বারকানাথ ইংল্যান্ড থেকে ফেরার সময় সঙ্গে নিয়ে এলেন বিখ্যাত বাগ্মী ও ভারত হিতৈষী, মহাত্মা জর্জ টমসনকে। জন্মেছিলেন দরিদ্র পরিবারে। নিজের অধ্যবসায় ও চেষ্টায় লেখাপড়া শিখলেন। ক্রমে হয়ে উঠলেন বিশ্বপ্রেমিক মহাপুরুষ। ইংল্যান্ড ও। আমেরিকার ক্রীতদাসপ্রথার বিরুদ্ধে শক্তিশালী আন্দোলন তিনি গড়ে তোলেন। দেশের দরিদ্র ও অত্যাচারিত জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শুরু করলেন। রাজা রামমোহন রায়ের বন্ধু রেভারেন্ড উইলিয়াম অ্যাডাম ইংল্যান্ডে স্থাপন করেছিলেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি। টমসন তার প্রধান সভ্য ছিলেন।
ভারতবর্ষে স্বদেশ ভাবনার সূত্রপাত হয়েছে। পাশ্চাত্য থেকে নানা ধরনের ভাব আসছে। সেদেশের মণীষীরা অন্য স্তরে চিন্তা শুরু করেছেন। যুদ্ধ-বিগ্রহ, রাজ্য দখল, কলোনি স্থাপন, হাজার হাজার মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খল পরিয়ে নিজেদের সুখবৃদ্ধি, মানুষের অন্তরে অধিষ্ঠিত দেবতাকে অস্বীকার করে পশুর মতো দেখা–এই একপেশে পৃথিবীর সমর্থন করছেন না। চিন্তাবিদরা। ভারতবর্ষে সেইসব ভাব ঢুকছে। বিভিন্ন দিকে একাধিক ভারতীয় ভারতমুক্তির কথা ভাবতে শুরু করেছেন। ভারত পরিক্রমা শেষ করে আর কয়েকদিন পরেই স্বামী বিবেকানন্দ যাবেন আমেরিকায়, ভারতের মহান আদর্শ, সভ্যতা ও আধ্যাত্মিকতার কথা মানুষকে জানাতে। তিনি পরদা ছিঁড়ে দেবেন। কয়েকবছর পরেই আসছেন সিস্টার নিবেদিতা, জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথ, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, ঋষি বঙ্কিম, শ্রীঅরবিন্দ, এই পটভূমিতে একে একে আত্মপ্রকাশ করবেন। সকলেরই উদ্দেশ্য ভারতের অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনা। রামমোহনের সুহৃদ দ্বারকানাথ কিছু কম যেতেন না। তিনিই নিয়ে এলেন চিন্তাবিদ টমসনকে। স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যাবে, বিদেশিদের ভূমিকা কিছু কম ছিল না। এই টমসন হলেন আদি ইন্ডোলজিস্ট। ভারতবর্ষ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা তাঁর উদ্দেশ্য হলেও এদেশের শিক্ষিত মানুষকে রাজনীতি সচেতন করার জন্য যথোচিত শিক্ষাও দিতে চান। ডিরোজিওর রেখে যাওয়া যুবক দলকে সব বিষয়েই অগ্রগণ্য মনে করা হত। তাঁরা অনেকটা এগিয়ে ভাবতে শিখেছেন। তাঁদের গুরুর শিক্ষা। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রভাবশালী সদস্য, ভারতবর্ষের প্রতি সহানুভূতিশীল টমসন। কলকাতায় এসেছেন। অকারণে আসেননি। শিক্ষিত তরুণ দলের সামনে একের পর এক অসাধারণ বক্তৃতার মাধ্যমে তাঁদের চনমনে করে তুলেছেন। শুধু ধর্ম, ধর্ম, ধর্ম ছাড়াও জাগরণের অন্য অনেক মার্গ আছে। সর্বাধিক প্রভাবিত হলেন, দক্ষিণারঞ্জন ও রামগোপাল ঘোষ। পরবর্তীকালে জনৈক গবেষক বলেছিলেন, ডিরোজিওর শিষ্যদের মধ্যে দক্ষিণারঞ্জনের মতো ব্রিলিয়ান্ট পলিটিশিয়ান আর কেউ ছিলেন না। এমনকী পলিটিক্যাল পাদরি কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা ভারতবর্ষের ডিমস্থিনিস রামগোপাল ঘোষও নন। ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়ার সম্পাদক মার্শম্যান তারাচাঁদ চক্রবর্তী প্রমুখ নব্য সংস্কারকদের। Chuckerburty faction নাম দিয়েছিলেন। জ্ঞানোপার্জিকা সভার অধিবেশনটি হিন্দু কলেজের একটি ঘরে হচ্ছিল। সেইসময় হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন ক্যাপ্টেন ডেভিড লেস্টার রিচার্ডসন। তিনি ছিলেন রক্ষণশীল টোরি দলভুক্ত। তিনি এই Chuckeburty faction-এর নব্য সংস্কার আন্দোলন ভালো চোখে দেখছিলেন না। এই সভার এক অধিবেশনে দক্ষিণারঞ্জন গবেষণামূলক একটি প্রবন্ধ পাঠ করলেন। বিষয়–Present condition of East India Companys Courts of judicature and police under the Bengal Presidency। এই বক্তৃতায় দক্ষিণারঞ্জন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসননীতির বেপরোয়া কিন্তু নিরপেক্ষ সমালোচনা করলেন। সভায় রিচার্ডসনও ছিলেন। বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর তিনি চিৎকার করে বললেন, I cannot convert the college into aden of treason। হিন্দু কলেজকে আমি কোনওভাবেই ষড়যন্ত্রকারীদের ডেরায় পরিণত করতে চাই না। সভার সদস্যরা রিচার্ডসনের এই কথায় অপমানিত বোধ করে মুহূর্তে সভা ত্যাগ করলেন। সভা করার জায়গার অভাব হল না। প্রথম শ্রীকৃষ্ণ সিংহের। বাগানবাড়িতে, তারপর বিখ্যাত ডাক্তার ডি গুপ্ত মহাশয়ের চেম্বারের দোতলায় ফৌজদারি বালাখানায়। দক্ষিণারঞ্জনের সেদিনের বক্তৃতা ইংরেজি সংবাদপত্রে ঝড় তুলেছিল। স্বাভাবিক! ইংরেজরা কেন সহ্য করবে। তাঁরা অত্যন্ত অভদ্র ভাষায় দক্ষিণারঞ্জনকে আক্রমণ করলেন। একজন সম্পাদক জেমস হিউম দক্ষিণারঞ্জনকে বললেন–Duck। কিন্তু বেঙ্গল হরকরা বক্তৃতাটি দুটি কিস্তিতে পুরোটাই ছাপল। সঙ্গে উচ্চ প্রশংসা, তারিখ, ১৮৪৩, ২ ও ৩ মার্চ।
হিন্দু কলেজ থেকে বিতাড়িত হলেও চক্রবর্তী মণ্ডলের উৎসাহে ভাটা পড়ল না বরং আরও উদগ্র হল। ফৌজদারি বালাখানায় টমসন একের পর এক জ্বালামুখী বক্তৃতার মাধ্যমে ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের জমি তৈরি করে দিচ্ছেন। ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়ার সম্পাদক মার্শম্যান লিখলেন, এখন দুদিকে কামানের গর্জন–পশ্চিম ভারতে বালাহিসারে আর কলকাতার ফৌজদারি বালাখানায়। সকলেই স্বীকার করবেন, আমাদের দেশের রাজনীতিক আন্দোলনের জন্মদাতা জর্জ টমসন। দিগম্বর মিত্রের ইংরাজি জীবনী লিখেছিলেন ভোলানাথ চন্দ্র। এক জায়গায় তিনি লিখছেন, ডেভিড হেয়ার যে ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন, জর্জ টমসন সেই জমিতে রাজনীতিক শিক্ষার বীজ বপন করলেন। যাঁরা স্বদেশি তাঁরা নাম রেখেছিলেন অবমোচনকারী টমসন। আমাদের দেশে তিনি রাজনীতির জন্মদাতা বলেই ধন্যবাদ ভাজন।