- বইয়ের নামঃ মধুর এক প্রেমকাহিনি
- লেখকের নামঃ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
১. ইংরেজের কলকাতা তখন বেশ সরগরম
ইংরেজের কলকাতা তখন বেশ সরগরম। মনে হচ্ছে বাংলার একটা নতুন ইতিহাস তৈরি হতে চলেছে। অতীতের যাবতীয় শাসক ও শাসন ঘটিত অশান্তির অবসান ঘটেছে। বর্গিদের হাঙ্গামা বাগে এসেছে। ফাঁসুড়ে ও ঠেঙাড়েরা ইংরেজ দাপটে জব্দ। তিনটি বিভাজন–সুতানুটি, কলকাতা ও গোবিন্দপুর আর নেই। এখন শুধুই কলকাতা ইংরেজের রাজধানী। কলকাতার যুবকরা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন। তাঁদের মানসিকতায় দ্রুত পরিবর্তন আসছে। প্রাচীনপন্থীদের দ্বারা অনুসৃত হিন্দুধর্ম তাঁদের সহ্য হচ্ছে না। শুধু শিক্ষা নয়, ধর্ম নিয়েও একটা দাপাদাপি শুরু হয়েছে। আদি ভট্টপল্লির কট্টর ব্রাহ্মণরা বলতে শুরু করেছেন–ফিরিঙ্গিদের সংস্পর্শে এসে উচ্ছন্নে যাওয়া কটা ছোঁড়া আমাদের ধর্মের পিণ্ডি চটকে দেবে দেখছি। পাদরিও এসে গেছেন। গির্জায় চলছে যিশুর ভজনা। আর চেষ্টা চলছে হিন্দুদের কীভাবে খ্রিস্টান করা যায়।
বাঙালির প্রথম সারির কয়েকজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন গুণী মানুষ জাতির জাগরণে অগ্রণী হয়েছেন। রাজনৈতিক স্বাধীনতা হারালেও মনে প্রাণে দাস হতে বাঙালি যে রাজি নয় তা তাঁরা প্রতিপন্ন করবেন। বাহুবলে শাসন দখল করলেও আমাদের মনোবলের কাছে তোমরা পরাজিত হবে। তোমরা সভ্য হওয়ার বহু আগেই হিন্দুরা সর্ব অর্থে সুসভ্য হয়েছে। আমাদের ধর্ম, আমাদের সংস্কৃত ভাষা, আমাদের দর্শন তোমাদের এমন কিছু দিতে পারে যা তোমাদের কোনও কালে ছিল না। সভ্যতার সংজ্ঞা আমাদের কাছেই জানতে হবে। সুপ্রাচীন কাল থেকে আমাদের ওপর দিয়ে বিদেশি আক্রমণের যে ঝড় বয়ে গেছে তার ফলে আমরা কোণঠাসা। আত্মরক্ষার জন্য এমন কিছু সংস্কার তৈরি করতে হয়েছে যা হয়তো কুসংস্কার। নারী স্বাধীনতা আমরা হরণ করতে চাইনি, বিদেশি লালসার হাত থেকে সুরক্ষার জন্য তাঁদের অন্তঃপুরে থাকার নিরাপদ ব্যবস্থা করতে হয়েছে।
জাগরণের কালের যুবকদের এইটিই হল প্রধান আক্রমণের স্থল। এর জন্য অপরিণত বুদ্ধিই হয়তো দায়ী। এই শতাব্দীতে, এই কলকাতা এমন একজন তরুণ শিক্ষককে পেয়েছিলেন। যাঁর সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা তৈরি হয়েছিল। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ তাঁকে ভালো চোখে
দেখলেও তিনি এই ইতিহাসের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও জাতিতে ফিরিঙ্গি। তাঁর শরীরে বিদেশি রক্ত। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর ভারতে তাঁর মতো স্বদেশপ্রেমিক ভারতীয় আর কে ছিলেন! একমাত্র ডিরোজিও বলতে পারেন,
স্বদেশ আমার, কিবা জ্যোতির মণ্ডলী
ভূষিত ললাট তব; অস্ত গেছে চলি
সেদিন তোমার হায়, সেই দিন-যবে
দেবতা সমান পূজ্য ছিলে এই ভবে।
কোথায় সে ব্যপদ! মহিমা কোথায়!
গগনবিহারী পক্ষী ভূমিতে লুটায়।
এই ডিরোজিওকে ঘিরে গড়ে উঠল শক্তিশালী এক যুবাগোষ্ঠী–ইয়ং বেঙ্গল। এই দলে যাঁরা ছিলেন পরবর্তীকালে তাঁদের সকলের নামের আগেই একটি করে বিশেষণ যুক্ত হয়েছে। যেমন, সত্যের উপাসক জ্ঞানবীর আচার্য কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, ভারতের ডিমস্থিনিস রামগোপাল ঘোষ। বঙ্গদেশে স্ত্রীশিক্ষা প্রবর্তনের পুরোহিত, অদ্বিতীয় রাজনীতিক রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধিশালী রাজা দিগম্বর মিত্র, অকৃত্রিম সাহিত্যসেবক অদ্ভুতকর্মা প্যারীচাঁদ মিত্র, পরহিব্রত সাধু শিবচন্দ্র দেব, মনীষী রসিক কৃষ্ণ মল্লিক, নিষ্কলঙ্ক চরিত্র রামতনু লাহিড়ী। উনবিংশ শতাব্দীতে পরপর এতগুলি আলোকস্তম্ভ। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে একই সঙ্গে আলোকপাত। তাঁদের মধ্যে থেকে আমাদের সামনে একজন এসে দাঁড়াবেন, তিনি ইতিহাসের নায়ক রাজা দক্ষিণারঞ্জন।
এইবার যেতে হবে দূর অতীতে। দুটি পরিবার একটি পরিবার ভট্টপল্লির মুখোপাধ্যায় বংশ, আর একটি কলকাতার গোপীমোহন ঠাকুরের বংশ। দুটি পরিবারের মধ্যে বৈবাহিক আদানপ্রদান হতে পারে না, কিন্তু হয়েছিল অতি নাটকীয় পরিস্থিতিতে। অনেকটা সেকালের উপন্যাসের মতো। পাত্রকে ধরে এনে প্রায় বন্দি করে কন্যা সম্প্রদান। মুখোপাধ্যায় বংশের পাত্র সম্রান্ত কুলীন আর ঠাকুর বংশ হল পিরালি। অর্থাৎ কোনও সময়ে, কোনও কারণে সামাজিকভাবে তাঁরা তাঁদের জাতি খুইয়েছিলেন। কোনও অপরাধ, সে অপরাধ স্লেচ্ছসংসর্গও হতে পারে। বল্লাল সেন যে কুল তালিকা ও মেল তৈরি করেছিলেন সেখানে পরবর্তীকালে দুটি বিভাজন ঘটেছিল। একটি হল, বিশুদ্ধ কুলীন, অন্যটি হল ভঙ্গ কুলীন। দ্বিতীয় বিভাজনটি একটু অদ্ভুত। এটি নেতিবাচক। কুল হারালেও কুলীন। সেই সময় বিশুদ্ধ কুল বজায় রাখা সম্ভব হত না। কারণ সমাজ জীবন তখন প্রসারিত হচ্ছে। বিদেশি সংমিশ্রণ ঘটছে, বিদেশি সংস্কৃতি ঢুকছে।
কলকাতায় স্বতন্ত্র একটি ইতিহাস তৈরি করে গেছেন ঠাকুর পরিবার। একদিকে পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর বংশ আর একদিকে জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবার। এই পরিবারকে জগৎ বিখ্যাত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। শুরুতে দুই ঠাকুর পরিবারই অর্থবিত্তে সমান ছিলেন। ঠাকুররা কলকাতায় এসেছিলেন যশোহর থেকে। তাঁদের আদি পুরুষ ভট্টনারায়ণ। আদিশূর কান্যকুজ থেকে যেসব ব্রাহ্মণদের এনেছিলেন তাঁদের মধ্যে ভট্টনারায়ণের পূর্বপুরুষরাও ছিলেন। ধাপে ধাপে নেমে এসেছেন। এই অবরোহণে এসে দাঁড়ালেন পঞ্চানন। তিনিই প্রথম ঠাকুর পদবি গ্রহণ করে কলকাতায় গোবিন্দপুরে এলেন। তাঁরই পুত্র জয়রাম। ইংরেজরা গোবিন্দপুর ফোর্ট তৈরি করবেন। জয়রামকে ইংরেজরা জায়গা দিলেন পাথুরিয়াঘাটাতে। ঠাকুর পরিবার তখনও দুই শাখাতে বিভক্ত হয়নি। জয়রামের চার পুত্র আনন্দীরাম, নীলমণি, দর্পনারায়ণ আর গোবিন্দরাম। একসময় নীলমণি পৃথক হয়ে সরে গেলেন জোড়াসাঁকোতে। অতিবিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের সূত্রপাত এইখানেই। অধস্তন চতুর্থ পুরুষে এলেন রবীন্দ্রনাথ। দর্পনারায়ণ সেকালের এক অতি সমৃদ্ধশালী ব্যক্তি–চন্দননগরের ফরাসি সরকারের প্রতাপশালী দেওয়ান। তাঁরই সুযোগ্য পুত্র গোপীমোহন।