নীলুকে দেখেই মিলি জুলি টপাটপ উঠে দৌড়ে এল।
মিলি বলে–তুমি বলেছিলে ভাত খেলে হাত এঁটো হয়। এঁটো কী?
দুজনকে দু’কোলে তুলে নিয়ে ভারী একরকমের সুখবোধ করে নীলু ওদের গায়ে শৈশবের আশ্চর্য সুগন্ধা
মিলি জুলি তার চুল, জামার কলার লণ্ডভণ্ড করতে থাকে। তাদের শরীরের ফাঁক দিয়ে মুখ বের করে নীলু বল্লরীকে বলে–তোমার হাঁড়ি চড়ে গেছে নাকি উনুনে।
–এইবার চড়বো বাজার এল এইমাত্র।
–হাঁড়ি ক্যানসেল করো আজ। বাপ গেছে বারুইপুরে। সকালেই বিশ চাক্কি ঝাঁক হয়ে গেল। সেটা পুষিয়ে নিতে হবে তো! তোমার এ দুটো পুঁটলি নিয়ে দুপুরের আগেই চলে যেও আমার গাজায়, খুমে লিও সবাই।
বল্লরী কেঁঝে ওঠে–কী যে সব অসভ্য কথা শিখেছেন বাজে লোকদের কাছ থেকে! নেমন্তন্নের ওই ভাষা!
বাথরুম থেকে শোভন চেঁচিয়ে বলে–চলে যাস না নীলু, কথা আছে।
–যেও কিন্তু। নীলু বল্লরীকে বলে–নইলে আমার প্রেস্টিজ থাকবে না।
–বাঃ, আমার যে ডালের জল চড়ানো হয়ে গেছে। এত বেলায় কি নেমন্তন্ন করে মানুষ!
নীলু সেসব কথায় কান দেয় না। মিলি জুলির সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে।
শোভন সকালেই দাড়ি কামিয়েছে। নীল গাল। মেদবহুল শরীরে এঁটে বসেছে ফিনফিনে গেঞ্জি, পরনে পাটভাঙা পায়জামা। গত বছর যৌথ পরিবার থেকে আলাদা হয়ে এল শোভনা বাসা খুঁজে দিয়েছিল নীলুই। চারদিনের নোটিশো এখন সুখে আছে শোভন। যৌথ পরিবারে থাকার সময়ে এত নিশ্চিন্ত আর তৃপ্ত আর সুখী দেখাত না তাকে।
পাছে হিংসা হয় সেই ভয়ে চোখ সরিয়ে নেয় নীলু।
নেমন্তন্নের ব্যাপার শুনে শোভন হাসে–আমিও যাব-যাব করছিলাম তোর কাছে। এর মধ্যেই চলে যেতাম ভালই হল।
এক কাপ চা আর প্লেটে বিস্কুট সাজিয়ে ঘরে আসে বল্লরী।
শোভন হতাশ গলায় বলে–বা মোটে এক কাপ করলে! ছুটির দিনে এ সময়ে আমারও তো এক কাপ পাওনা।
বল্লরী গম্ভীরভাবে বলে–বাথরুমে যাওয়ার আগেই তো এক কাপ খেয়েছ।
মিষ্টি ঝগড়া করে দুজন মিলি জুলির গায়ের অদ্ভুত সুগন্ধে ডুবে থেকে শোভন আর বল্লরীর আদর-করা গলার স্বর শোনে নীলু। সম্মোহিত হয়ে যেতে থাকে।
তারপরই হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বলে–চলি রে? তোরা ঠিক সময়ে চলে যাস।
–শুনুন শুনুন, আপনার সঙ্গে কথা আছে। বল্লরী তাকে থামায়।
–কী কথা?
–বলছিলুম না আজ সকালেই ভেবেছি আপনার কথা তার মানে নালিশ আছে একটা কারা বলুন তো আমাদের বাড়ির দেওয়ালে রাজনীতির কথা লিখে যায়? তারা কারা? আপনাদের তো এলাকা এটা, আপনার জানার কথা।
–কী লিখেছে?
–সে অনেক কথা ঢোকার সময়ে দেখেননি? বর্ষার পরেই নিজেদের খরচে বাইরেটা রং করালুম দেখুন গিয়ে, কালো রং দিয়ে ছবি এঁকে লিখে কী করে গেছে শ্রী! তা ছাড়া রাতভর লেখে, গোলমালে আমরা কাল রাতে ঘুমোতে পারিনি।
নীলু উদাসভাবে বলে–বারণ করে দিলেই পারো।
–কে বারণ করবে? আপনার বন্ধু ঘুমোতে না পেরে উঠে সিগারেট ধরাল আর ইংরিজিতে আপনমনে গালাগাল দিতে লাগল–ভ্যাগাবন্ডস, মিসফিটস, প্যারাসাইটস… আরও কত কী! সাহস নেই যে উঠে ছেলেগুলোকে ধমকাবো
–তা তুমি ধমকালে না কেন? নীলু বলে উদাস ভাবটা বজায় রেখেই।
বল্লরী হাসল উজ্জ্বলভাবে। বলল–ধমকাইনি নাকি! শেষমেষ আমিই তো উঠলাম। জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে বললাম–ভাই, আমরা কি রাতে একটু ঘুমোব না? আপনার বন্ধু তো আমার কাণ্ড দেখে অস্থির। পিছন থেকে আঁচল টেনে ফিসফিস করে বলছে–চলে এসো, ওরা ভীষণ ইতর, যা তা বলে দেবে। কিন্তু ছেলেগুলো খারাপ না। বেশ ভদ্রলোকের মতো চেহারা। ঠোঁটে সিগারেট জ্বলছে, হাতে কিছু চটি চটি বই, প্যামফলেটা আমার দিকে হাতজোড় করে বলল–বৌদি, আমাদেরও তো ঘুম নেই। এখন তো ঘুমের সময় না এদেশো বললুম–আমার দেয়ালটা অমন নোংরা হয়ে গেল যে! একটা ছেলে বলল–কে বলল নোংরা! বরং আপনার দেয়ালটা অনেক ইস্পট্যান্ট হল আগের চেয়ে। লোক এখান দাঁড়াবে, দেখবে, জ্ঞানলাভ করবো আমি। বুঝলুম খামোখা কথা বলে লাভ নেই। জানালা বন্ধ করতে যাচ্ছি অমনি একটা মিষ্টি চেহারার ছেলে এগিয়ে এসে বলল–বৌদি, আমাদের একটু চা খাওয়াবেন? আমরা ছ’জন আছি!
নীলু চমকে উঠে বলে–খাওয়ালে না কি?
বল্লরী মাথা হেলিয়ে বলল–খাওয়াব না কেন?
–সে কী!
শোভন মাথা নেড়ে বলল–আর বলিস না, ভীষণ ডেয়ারিং এই মহিলাটি। একদিন বিপদে পড়বো
–আহা, ভয়ের কী! এইটুকু-টুকু সব ছেলে, আমার ভাই বাবলুর বয়সী মিষ্টি কথাবার্তা তাছাড়া এই শরতের হিমে সারা রাত জেগে বাইরে থাকছে–ওদের জন্য না হয় একটু কষ্ট করলাম!
শোভন হাসে, হাত তুলে বল্লরীকে থামিয়ে বলে–তার মানে তুমিও ওদের দলে।
–আহা, আমি কী জানি ওরা কোন দলের? আজকাল হাজারো দল দেয়ালে লেখো আমি কী করে বুঝব!
–তুমি ঠিকই বুঝেছ। তোমার ভাই বাবলু কোন দলে তা কি আমি জানি না! সেদিন খবরের কাগজে বাবলুর কলেজের ইলেকশনের রেজাল্ট তোমাকে দেখালুম না? তুমি ভাইয়ের দলের সিমপ্যাথাইজারা।
অসহায়ভাবে বল্লরী নীলুর দিকে তাকায়, কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে–না, বিশ্বাস করুন। আমি দেখিওনি ওরা কী লিখেছে।
নীলু হাসে–কিন্তু চা তো খাইয়েছ!
–হ্যাঁ। সে তো পাঁচ মিনিটের ব্যাপার গ্যাস জ্বেলে ছ পেয়ালা চা করতে কতক্ষণ লাগে! ওরা কী খুশী হল! বলল–বৌদি দরকার পড়লে আমাদের ডাকবেন। যাওয়ার সময়ে পেয়ালাগুলো জল দিয়ে ধুয়ে দিয়ে গেল। ওরা ভাল না?