আজ সকালে তাই বৃটিশকে খুঁজছে নীলু। মাসের একুশ তারিখ বৃটিশের কাছে ত্রিশ টাকা পাওনা। গত শীতে দর্জির দোকান থেকে বৃটিশের টেরিকটনের প্যান্টটা ছাড়িয়ে দিয়েছিল নীলু এতদিন চায়নি। গতকাল নিয়ে যেতে পারত, কিন্তু মাতালের কাছ থেকে নেওয়া উচিত নয় বলে নেয়নি। আজ দেখা হলে চেয়ে নেবে।
চায়ের দোকানে বৃটিশকে পাওয়া গেল না। ভি. আই. পি. রোডের মাঝখানে যে সবুজ ঘাসের চত্বরে বসে তারা আড্ডা মারে, সেখানেও না। ফুলবাগানের মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দেখল নীলু। কোথাও নেই। কাল রাতে নীলু বেশিক্ষণ ছিল না হরতুনের দোকানো জাপান, জগু ওরা বৃটিশকে ঘিরে বসেছিল। বহুকাল তারা এমন মানুষ দেখেনি যার পকেটে ফালতু দুশো টাকা। জাপান মুখ চোখাচ্ছিল। কে জানে রাতে আবার ওরা ট্যাক্সি ধরে ধর্মতলার দিকে গিয়েছিল কিনা! গিয়ে থাকলে ওরা এখনও বিছানা নিয়ে আছে। দুপুর গড়িয়ে উঠবে বৃটিশের বাড়িতে আজকাল আর যায় না নীলু বৃটিশের মা আর দাদার সন্দেহ ওকে নষ্ট করেছে নীলুই। নইলে নীলু গিয়ে বৃটিশকে টেনে তুলত বিছানা থেকে, বলত,–না-হকের পয়সা পেয়েছিস, হিস্যা চাই না, আমার হকেরটা দিয়ে দেয়।
নাঃ আবার ভেবে দেখল নীলু। দুশো টাকা–মাত্র দুশো টাকার আয়ু এ বাজারে কতক্ষণ? কাল যদি ওরা সেকেন্ড টাইম গিয়ে থাকে ধর্মতলায় তবে বৃটিশের পকেটে এখন হপ্তার খরচও নেই।
মোড়ে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরায় নীলু ভাবে, বিশ চাক্কি যদি ঝাঁক হয়েই গেল তবে কীভাবে বাড়ির লোকজনের ওপর একটা মৃদু প্রতিশোধ নেওয়া যায়!
অমনি শোভন আর তার বৌ বল্লরীর কথা মনে পড়ে গেল তারা শোভন কাজ করে কাস্টমসে। তিনবারে তিনটি বিলিতি টেরিলিনের শার্ট তাকে দিয়েছে শোভন, আর দিয়েছে সস্তার একটা ঘড়ি। তার ভদ্রলোক বন্ধুদের মধ্যে শোভন একজন–যাকে বাড়িতে ডাকা যায়। কতবার ভেবেছে নীলু শোভন, বল্লরী আর ওদের দুটো কচি মেয়েকে এক দুপুরের জন্য বাড়িতে নিয়ে আসবে, খাইয়ে দেবে ভাল করে খেয়ালই থাকে না এসব কথা।
মাত্র তিন স্টপ দূরে থাকে শোভনা মাত্র সকাল ন’টা বাজে। আজ ছুটির দিন, বল্লরী নিশ্চয়ই রান্না চাপিয়ে ফেলেনি! উনুনে আঁচ দিয়ে চা-ফা, লুচি-ফুচি হচ্ছে এখনো। দুপুরে খাওয়ার কথা। বলার পক্ষে খুব বেশি দেরি বোধহয় হয়নি এখনো।
ছত্রিশ নম্বর বাসটা থামতেই উঠে পড়ল নীলু।
উঠেই বুঝতে পারে, বাসটা দখল করে আছে দশ বারোজন ছেলে-ছোকরা। পরনে শার্ট পায়জামা, কিংবা সরু প্যান্ট। বয়স ষোলোর এদিক ওদিক তাদের হাসির শব্দ থুথু ফেলার আগের গলাখাঁকারির–খ্যা-অ্যা-অ্যা-র মতো শোনাচ্ছিল। লেডিজ সিটে দু-তিনজন মেয়েছেলে। বাইরের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে। দু-চারজন ভদ্রলোক ঘাড় সটান করে পাথরের মতো সামনের শূন্যতার দিকে চেয়ে আছে। ছোকরারা নিজেদের মধ্যেই চেঁচিয়ে কথা বলছে। উল্টো-পাল্টা কথা, গানের কলি। কন্ডাক্টর দুজন দুদরজায় সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে। ভাড়া চাইবার সাহস নেই!
তবু ছোকরাদের একজন দলের পরমেশ নামে আর একজনকে ডেকে বলছে–পরমেশ, আমাদের ভাড়াটা দিলি না?
–কত করে?
–আমাদের হাফ-টিকিটা পাঁচ পয়সা করে দিয়ে দে।
–এই যে কন্ডাক্টরদাদা, পাঁচ পয়সার টিকিট আছে তো! বারোখানা দিন।
পিছনের কন্ডাক্টর রোগা, লম্বা, ফর্সা না-কামানো কয়েক দিনের দাড়ি থুতনিতে জমে আছে। এবড়োখেবড়ো গজিয়েছে গোঁফ। তাতে তাকে বিষণ্ণ দেখায়। সে তবু একটু হাসল ছোকরাদের কথায়। অসহায় হাসিটি।
নীলু বসার জায়গা পায়নি। কন্ডাক্টরের পাশে দাঁড়িয়ে সে বাইরের দিকে মুখ ফিরিয়ে ছিল।
বাইরে কোথাও পরিবার পরিকল্পনার হোর্ডিং দেখে জানালার পাশে বসা একটা ছেলে চেঁচিয়ে বলল–লাল ত্রিভুজটা কী বল তো মাইরি!
–ট্রাফিক সিগন্যাল বে, লাল দেখলে থেমে যাবি।
–আর নিরোধ! নিরোধটা কী যেন।
–রাজার টুপি…রাজার টুপি…
–খ্যা-অ্যা-অ্যা-খ্যা-অ্যা-অ্যা…
–খ্যা…
পরের স্টপে বাস আসতে তারা হেঁকে বলল–বেঁধে…লেডিজ…
নেমে গেল সবাই। বাসটাকে ফাঁকা নিস্তব্ধ মনে হল এবার। সবাই শরীর শ্লথ করে দিল। একজন চশমা-চোখে যুবা কন্ডাক্টরের দিকে চেয়ে বলল–লাথি দিয়ে নামিয়ে দিতে পারেন না এসব এলিমেন্টকে!
কন্ডাক্টর ম্লান মুখে হাসে
ঝুঁকে নীলু দেখছিল ছেলেগুলো রাস্তা থেকে বাসের উদ্দেশে টিটকিরি ছুঁড়ে দিচ্ছে। কান কেমন গরম হয়ে যায় তারা লাফিয়ে নেমে পড়তে ইচ্ছে করে। লাঠি ছোরা বোমা যা হোক অস্ত্র নিয়ে কয়েকটা খুন করে আসতে ইচ্ছে করে।
হঠাৎ পোগোর মুখখানা মনে পড়ে নীলুর। জামার আড়ালে ছোরা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে পোগো। স্বপ্ন দেখছে মার্ডারের তারা সবাই পোগোর পিছনে লাগে, মাঝে মধ্যে লাথি কষায়। তবু কেন যে পোগোর মতোই এক তীব্র মার্ডারের ইচ্ছে জেগে ওঠে নীলুর মধ্যেও মাঝে মাঝে এত তীব্র সেই ইচ্ছে যে আবেগ কমে গেলে শরীরে একটা অবসাদ আসে। তেতো হয়ে যায় মন।
শোভন বাথরুমে বল্লরী এসে দরজা খুলে চোখ কপালে তুলল–ওমা, আপনার কথাই ভাবছিলাম সকালবেলা অনেকদিন বাঁচবেন।।
শোভনের বৈঠকখানাটি খুব ছিমছাম, সাজানো। বেতের সোফা, কাচের বুককেস, গ্র&ন্ডিগের রেডিওগ্রাম, কাঠের টবে মানিপ্ল্যান্ট, দেয়ালে বিদেশি বারো-ছবিওলা ক্যালেন্ডার, মেঝেয় কয়ের কার্পেটা মাঝখানে নিচু টেবিলের ওপর মাখনের মতো রঙের ঝকঝকে অ্যাশ-ট্রে-টার সৌন্দর্যও দেখবার মতন। মেঝেয় ইংরিজি ছড়ার বই খুলে বসে ছিল শোভনের চার আর তিন বছর বয়সের মেয়ে মিলি আর জুলি। একটু ইংরিজি কায়দায় থাকতেই ভালবাসে শোভন। মিলিকে কিন্ডারগার্টেনের বাস এসে নিয়ে যায় রোজ। সে ইংরিজি ছড়া মুখস্থ বলে।