তখনই বোঝা গেল বুড়ো চাক্কি রেখে যায়নি। কাল নাকি টাকা তুলতে রানাকে পাঠিয়েছিল কিন্তু দস্তখত মেলেনি বলে উইথড্রয়াল ফর্ম ফেরত দিয়েছে পোস্টাপিস। কিন্তু নীলু জানে পুরোটা টিকরমবাজি। বুড়ো আগে ছিল রেলের গার্ড, রিটায়ার করার পর একটা মুদির দোকান দিয়েছিল–অনভিজ্ঞ লোক, তার ওপর দোকান ভেঙে খেতো–ফলে দোকান গেল উঠো এখন তিন রোজগেরে ছেলের টাকা নিয়ে পোেস্ট-অফিসে রাখে আর প্রতি সপ্তাহে খরচ তোলে। প্রতিদিন বাজারের থলি দশমেসে পেটের মতো ফুলে না থাকলে বুড়োর মন ভজে না। মাসের শেষ দিকে টাকা ফুরোলেই টিকরমবাজি শুরু হয়। প্রতি সপ্তাহে যে লোক টাকা তুলছে তার নাকি দস্তখত মেলে না!
নীলু হাসে। সে কখনো বুড়োর ওপর রাগ করে না বাবা তার দিকে আড়ে আড়ে চায় মাসের শেষ দিকটা। ঝাঁক দেওয়ার নানা চেষ্টা করে। নীলুর সঙ্গে বাবার একটা লুকোচুরির খেলা চলতে থাকো।
বাঙালের খাওয়া তার ওপর পুঁটিয়ারির নাড়মামা, মামী, ছেলে, ছেলের বৌ–চারটে বাইরের লোক নিমন্ত্রিত, ঘরের লোক বারোজন–নীলু নিজে, মা, ছটা ভাই, দুটো ধুমসী বোন, বিধবা মাখনী পিসি, বাবার জ্যাঠতুতো ভাই, আইবুড়ো নিবারণ কাকা–বিশ চাকির নীচে বাজার নামে?
রবিবার বাজার নামিয়ে রেখে নীলু একটু পাড়ায় বেরোয়। কদিন ধরেই পোগো ঘুরছে পিছন পিছন। তার কোমরে নানা আকৃতির সাতটা ছুরি। ছুরিগুলো তার মায়ের পুরোনো শাড়ির পাড় ছিঁড়ে তাই দিয়ে জড়িয়ে সযত্নে শার্টের তলায় গুঁজে রাখে পোগো পাড়ার লোক বলে, পোগো দিনে সাতটা মার্ডার করে। নিতান্ত এলেবেলে লোকও পোগোকে যেতে দেখলে হেঁকে ডাক পাড়ে–কী পোগোবাবু, আজ কটা মার্ডার হল? পোগো হুম হাম করে চলে যায়।
পরশু দিন পোগোর মেজোবৌদি জানালা দিয়ে নীলুকে ডেকে বলেছিল–পোগো যে তোমাকে মার্ডার করতে চায়, নীলু, খবর রাখো?
তাই বটে। নীলুর মনে পড়ল, কয়েকদিন যাবৎ সে অফিসে যাওয়ার সময়ে লক্ষ্য করেছে পোগো নিঃশব্দে আসছে পিছনে পিছনে বাস-স্টপ পর্যন্ত আসে। নীলু কখনো ফিরে তাকালে পোগো উধ্বমুখে আকাশ দেখে আর বিড়বিড় করে গাল দেয়।
আজ বিশ চাক্কি ঝাঁক হয়ে যাওয়ায় নীলুর মেজাজ ভাল ছিল না। নবীনের মিষ্টির দোকানের সিঁড়িতে বসে সিগারেট ফুঁকছিল পোগো। নীলুকে দেখেই আকাশে তাকাল না-দেখার ভান করে কিছুদূর গিয়েই নীলু টের পেল পোগো পিছু নিয়েছে।
নীলু ঘুরে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে পোগো উল্টোবাগে ঘুরে হাঁটতে লাগল এগিয়ে গিয়ে তার পাছায় ডান পায়ের একটা লাথি কষাল নীলু–শালা, বদের হাঁড়ি।
কাঁই শব্দ করে ঘুরে দাঁড়ায় পোগো। জিভ আর প্যালেটের কোনো দোষ আছে পোগোর, এখনও জিভের আড় ভাঙেনি। ছত্রিশ বছরের শরীর তিন বছর বয়সী মগজ নিয়ে সে ঘুরে বেড়ায়। গরম খেয়ে বলল-খুব ঠাবহান, নীলু, বলে ডিট্টি খুব ঠাবহান
–ফের! কষাব আর একটা?
পোগো থিতিয়ে যায়। শার্টের ভিতরে লুকোনো হাত ছুরি বের করবার প্রাক্কালের ভঙ্গিতে রেখে বলে–একডিন ফুটে ডাবি ঠালা
নীলু আর একবার ডান পা তুলতেই পোগো পিছিয়ে যায়। বিড়বিড় করতে করতে কারখানার পাশের গলিতে ঢুকে পড়ে।
সেই কবে থেকে মার্ডারের স্বপ্ন দেখে পোগো সাত-আটখানা ছুরি বিছানায় নিয়ে ঘুমোতে যায়। পাছে নিজের ছুরি ফুটে ও নিজে মরে–সেই ভয়ে ও ঘুমোলে ওর মা এসে হাতড়ে হাতড়ে ছুরিগুলো সরিয়ে নেয়। মার্ডারের বড় শখ পোগোরা সারাদিন সে লোককে কত মার্ডারের গল্প করে! কলকাতায় হাঙ্গামা লাগলে ছাদে উঠে দুহাত তুলে লাফায়। মার্ডারের গল্প যখন শোনে। তখন নিথর হয়ে যায়।
নীলু গতবার গ্রীষ্মে দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে একটা ভোজালি কিনেছিল। তাই সেই শখের ভোজালিটা দিনসাতেক আগে একদিনের জন্য ধার নিয়েছিল পোগো। ফেরত দেওয়ার সময়ে চাপা গলায় বলেছিল–ভয় নেই, ভাল করে ঢুয়ে ডিয়েছি।
–কী ধুয়েছিস? জিজ্ঞেস করেছিল নীলু।
অর্থপূর্ণ হেসেছিল পোগো, উত্তর দেয়নি। তোমরা বুঝে নাও কী ধুয়েছি। সেদিনও একটা লাথি কষিয়েছিল নীলু–শালার শয়তানী বুদ্ধি দেখা ধুয়ে দিয়েছি–কী ধুয়েছিস আব্বে পোগোর বাচ্চা?
সেই থেকেই বোধহয় নীলুকে মার্ডার করার জন্য ঘুরছে পোগো। তার লিস্টে নীলু ছাড়া আরও অনেকের নাম আছে যাদের সে মার্ডার করতে চায়।
আজ সকালে বৃটিশকে খুঁজছে নীলু কাল বৃটিশ জিতেছে। দুশো সত্তর কি আশি টাকা। সেই নিয়ে খিচাং হয়ে গেল কাল!
গলির মুখ আটকে খুদে প্যান্ডেল বেঁধে বাচ্চচাদের ক্লাবের রজত জয়ন্তী হচ্ছিল কাল সন্ধেবেলায়। পাড়ার মেয়ে-বৌ, বাচ্চারা ভিড় করেছিল খুব সেই ফাংশন যখন জমজমাট, তখন বড় রাস্তায় ট্যাক্সি থামিয়ে বৃটিশ নামল টলতে টলতে ঢুকল গলিতে, দু বগলে বাংলার বোতল সঙ্গে ছটকু। পাড়ায় পা দিয়ে ফাংশনের ভিড় দেখে নিজেকে জাহির করার জন্য দুহাত ওপরে তুলে হাঁকাড় ছেড়েছিল বৃটিশ–ঈ-ঈ-ঈদ কা চাঁ-আ-আ-দ! বগল থেকে দুটো বোতল পড়ে গিয়ে ফট-ফটাস করে ভাঙলা হুড়দৌড় লেগে গিয়েছিল বাচ্চচাদের ফাংশনে পাঁচ বছরের টুমিরানি তখন ডায়াসে দাঁড়িয়ে কাঠবেড়ালী, কাঠবেড়ালী, পেয়ারা তুমি খাও…’ বলে দুলতে দুলতে থেমে ভ্যাঁ করার জন্য হাঁ করেছিল মাত্র। সেই সময়ে নীলু, জগু, জাপান এসে দুটোকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল হরতুনের চায়ের দোকানো নীলু বৃটিশের মাথায় জল ঢালে আর জাপান। পিছন থেকে হাঁটুর গুঁতো দিয়ে জিজ্ঞেস করে–কত জিতেছিস? প্রথমে বৃটিশ চেঁচিয়ে বলেছিল–আব্বে, পঞ্চা-আ-শ হা-জা-আর। জাপান আরও দুবার হাঁটু চালাতেই সেটা নেমে দাঁড়াল দু হাজারো সেটাও বিশ্বাস হল না কারও। পাড়ার বুকি বিশুর কাছ থেকে সবাই জেনেছে, ঈদ কা চাঁদ হট ফেবারিট ছিল। আরও কয়েকবার ঝাঁকাড় খেয়ে সত্যি কথা বলল বৃটিশ–তিনশো, মাইরি বলছি বিশ্বাস করা পকেট সার্চ করে শদুয়ের মতো পাওয়া গিয়েছিল।