নয়? তোর তো দেখছি তুরীয় অবস্থা, মুতের গন্ধ পায় না, এমন আহাম্মক কে?
সমীরণ ভারি কাঁচুমাচু হল। মুতের গন্ধের দোষ কী? মোতি নামের বেড়ালটার প্রসব হয়েছে ক-দিন। চৌকির তলায় তার আঁতড়ঘর। অপকর্মটা হয়তো মোতিই করে। কে জানে বাবা!
নবাবগঞ্জের মেয়েটা বাতিল হয়ে গেল, বুঝলি!
বুঝল না সমীরণ। বলল, কোন মেয়ে?
আমার খুব পছন্দ ছিল। গণেশদাদাও বলছিল দুর্গাপ্রতিমার মতো দেখতে। কিন্তু সেজোবউ বলল, মেয়ের খুঁত আছে। কী খুঁত তা ভেঙে বলল না। মেয়েলি ব্যাপার, কে জানে বাবা কী! মোটমাট বাতিল।
ও। আচ্ছা। সমীরণ এর বেশি আর কী বলবে?
সমীরণ চেয়ে রইল।
ও মেয়ে দেখার পর সেজোবউ ভয় পেয়েছে, সুন্দরী বলে তার যে গ্ল্যামার ছিল তা এবার যাবে। নবদুর্গা এলে তাকে কেউ ফিরেও দেখবে না। তা বলে মুখের ওপর অমন কটমট করে কথা না শোনালেও পারত।
কী কথা জ্যাঠা!
এই হেনতেন, মেয়েদের অনেক কায়দা জানা আছে। বিধিয়ে বিধিয়ে এমন বলে। মেয়েটা ভারি দুঃখ পেল।
সমীরণ একটু বিষণ্ণ হল। মুখের ওপর কাউকে বাতিল করা কি ভালো?
তুই মুতের গন্ধ পাস না কেন রে? এঃ বাবা, নাক যে জ্বালা করছে।
সমীরণ পায় না, তা কী করবে। ভারি দুঃখী হয়ে সে বসে রইল। হোক মুতের গন্ধ তা বলে কি, সে মোতিকে বাচ্চাসমেত ঘরের বার করতে পারে? সমীরণ অনেক কিছুই পারে না, যা পারা উচিত।
তাঁতঘরে আজ সারাদিন ভারি আনমনা রইল সমীরণ। অন্যদিন তাঁতের শব্দ তার সঙ্গে নানা কথা বলে। শুনলে লোকে তাকে আরও পাগল বলবে বলে, সে-কথাটা কাউকে বলে না। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী তাঁতের সঙ্গে তার নানা কথা হয়। তাঁতও তার কথা বুঝতে পারে, সেও বোঝে তাঁতের ভাষা।
আজ তাঁত বলল, পরশু শিবরাত্রি।
হ্যাঁ, তা জানি, তাতে কী?
জান? ভালো। এই বলছিলাম আর কী, শিবরাত্রি ভারি ভালো দিন।
অ। তা হবে। আজ আমার মনটা ভালো নেই।
ভালো না থাকারই কথা। বলি কি শিবরাত্রির দিনই গিয়ে নবাবগঞ্জে হানা দাও। মেয়েটার কাছে ক্ষমা চেয়ে নাও।
যাব?
যাও। খুঁতো মেয়ে বলছে, তা খুঁতো নয় কে? সবাই খুঁতো।
সমীরণ একটা শ্বাস ফেলল। বলল, দুনিয়াটা কেমনধারা বলো তো!
তোমার জায়গা নয় হে এটা। তুমি হলে পাগল আর বোকা।
তা তো জানি।
ওরকমই থাকো। অন্যরকম হওয়ার কথা নয় তোমার। ঠাকুর যেমনটি করেছেন তোমায় তেমনটিই থাকো।
.
৩.
জগাখুড়ো এসে বলেছিল, তোর কপালে হলে হয়। ছেলে পাগল ঠিকই, বোকাও হয়তো, কিন্তু ভগবান কাউকে কাউকে পাঠান। এ তার নিজের লোক।
পাগল আর বোকা! মাগো!
জগাখুড়ো যেন কেমনধারা পাগুলে চোখে আনমনা চেয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলল, সংসারী হিসেবে সে। এমন কিছু আহামরি নয়। তবে অন্য একটা হিসেবও তো আছে।
অন্য হিসেব—
এই অন্য হিসেবটা বোঝে না নবদুর্গা। সে তো সংসারী মানুষ, বুঝবে কী করে? আবার তার মনটা মাঝে। মাঝে ভারি মেদুর হয়ে যায়, ভারি অন্যরকম, তখন সে ঠিক সংসারী থাকে না। তখন তারও হিসেব উলটেপালটে যায়।
গোবিন্দপুরের লোকেরা এসেছিল। তাকে নাকচ করে গেছে মুখের ওপরেই। ভগবানের লোকের সঙ্গে তার বিয়েটা হচ্ছে না। একটা বউ এসেছিল তাদের সঙ্গে–দেখতে ভারি ঢলঢলে। কিন্তু জিবের যা ধার। মিষ্টি মিষ্টি করে এমন সব কথা বলল, রংটা তো তেমন নয়, চুলের গোছ কী আর ভালো, দাঁতগুলো অমন কেন, পান খাও নাকি? পোকা নয় তো! খামোখা কথা সব। বলতে হয় বলে বলা।
কাল শিবরাত্রির উপোস গেছে। আজ নবদুর্গার শরীর ভারি দুর্বল। সকালে কাঁচা মুগ ভেজানো গুড় দিয়ে খেয়েছে আর মিছরির শরবত। শরীর নয়, মনটাই যেন আজ কেমনধারা। শিবরাত্রি করে কী হয়? কচু হয়। কিছু হয় না। ন-বছর বয়স থেকে শিবরাত্রি করে আসছে সে। কিছু হল?
জগাখুড়ো এল বেলা ন-টা নাগাদ।
আছিস নাকি ঘরে?
আছি গো, কেন?
শরীর খারাপ নাকি?
ব্রত করলাম-না?
ও, তাই তো বটে!
জগাখুড়োর মুখে কেমন যেন বোকা-বোকা হাসি। মাথাটাথা চুলকে বলল, ওই একটা ব্যাপার হয়েছে। কী ব্যাপার খুড়ো?
বাড়ির লোক টের পেলে কী করবে কে জানে?
ভয় খেয়ে নবদুর্গা উঠে বসল। তার যে বুক দুরদুর করছে!
কী হল খুড়ো?
আমার ঘরটায় একবার যা। একজন এসে বসে আছে। বড় দুঃখী মানুষ।
কে গো?
যা-না। দেখে যদি বুঝতে পারিস তবেই হয়। যা একবার।
নবদুর্গার বুকের মধ্যে কেমন যেন আছাড়ি পিছাড়ি ভাব। বড়ড মোচড় দিচ্ছে পেটের মধ্যে। মুখ শুকিয়ে কাঠ। সে তবু উঠল।
খুড়োর ঘর পর্যন্ত যেতে উঠোনটা যেন তেপান্তরের মাঠ। সিঁড়ি মোটে এক ধাপ। তাও পেরোতে যেন হাঁটু ভেঙে এল। ঘরের দাওয়ায় উঠে দরজা অবধি যেন যেতেই পারছিল না। দরজায় থমকে গেল।
একে সে এ-জন্মে দেখেনি ঠিক। কিন্তু এ তার সাত জন্মের চেনা। এ কি আজকের?
অপরাধী একজোড়া চোখ তুলে সে চাইল। তারপর তার চোখও পলকহীন। চিনেছে কি? হ্যাঁ চিনেছে। সেই চেনার ঝিকিমিকি চোখে উথলে উঠল।
নবদুর্গা একটু হেসে মাথা নোয়াল।
দুজনের কোনো কথা হল না। শুধু আড়াল থেকে জগাখুড়োর মৃদু গলা খাঁকারির একটা শব্দ হল। উঠোনের ওধার থেকে লছমি হঠাৎ ডেকে উঠল অকারণে। কিংবা কে জানে তত অকারণে হয়তো নয়।
নীলুর দুঃখ
সক্কালবেলাতেই নীলুর বিশ চাক্কি ঝাঁক হয়ে গেল। মাসের একুশ তারিখ ধারে কাছে কোনো পেমেন্ট নেই। বাবা তিনদিনের জন্য মেয়ের বাড়িতে গেছে বারুইপুর–মহা টিকরমবাজ লোক–সাউথ শিয়ালদায় গাড়িতে তুলে দিয়ে নীলু যখন প্রণাম করল তখন হাসি-হাসি মুখে বুড়ো নতুন সিগারেটের প্যাকেটের সিলোফেন ছিড়ছে। তিনদিন মায়ের আওতার বাইরে থাকবে বলে বুঝি ওই প্রসন্নতা–ভেবেছিল নীলু। গাড়ি ছাড়বার পর হঠাৎ খেয়াল হল, তিনদিনের বাজার খরচ রেখে গেছে তো! সেই সন্দেহ কাল সারা বিকেল খচখচ করেছে। আজ সকালেই মশারির মধ্যে আধখানা ঢুকে তাকে ঠেলে তুলল মা–বাজার যাবি না, ও নীলু?