গজগজ করতে করতে ডাক্তার সাউ লোকটাকে দেখল। দেখতে দেখতে বলল, বলেছি না, এ-শালা বেজন্মাদের ওষুধ লাগে না। দিব্যি বেঁচে আছে। মারের চোটে ভিরমি খেলেও কিছু নয়। টিকে যাবে। নিয়ে। যাও।
একটু ওষুধ-টষুধ দেবেন-না?
পয়সা?
হবে।
দেখো বাপু। বাকি কারবারে ফেলো না। অনেক ভিজিট মার গেছে আমার জীবনে।
তা ওষুধ হল, পট্টিও লাগানো হল। লোকটা একটু খোলা চোখে চাইলও।
সমীরণ বারোটা টাকা হিসেবমতো দিয়ে দিল। তারপর লোকটাকে দাঁড় করিয়ে বলল, চল ব্যাটা। বেঁচে গেছিস।
লোকটা টলতে টলতে বেরিয়ে এল সঙ্গে সঙ্গে।
কুমোরপাড়ার রাস্তায় পড়ে লোকটা সটান হল। বলল, বাবু কি আমাকে পুলিশে দিচ্ছেন?
দেওয়াই উচিত।
ও শালা পুঙ্গির ভাইয়েরা যে পেটাল ওদের কী করছেন?
হাটসুদ্ধ কি পুলিশে দেওয়া যায়? বেশ করেছে মেরেছে।
বেশ করা আমিও বের করে দেব, দেখবেন। বনমালির দোকান থেকে–বললে বিশ্বেস করবেন না–মোটে পাঁচটি টাকা কুড়িয়েছি তাইতেই এই কান্ড।
কুড়িয়েছ মানে?
বনমালি ক্যাশবাক্স খুলে টাকা খাবলে কাকে যেন খুচরো ফেরত দিতে যাচ্ছিল, পাঁচ টাকার নোটটা উড়ে এসে পড়ে মাটিতে। সেইটে কুড়িয়ে গস্ত করায় এই হেনস্থা।
তুমি চোর নও তা হলে?
কোন শালা নয়। সব চোর। হাটে-বাজারে পথেঘাটে দাঁড়িয়ে যেদিকে তাকাব সব চোর।
জানি। বাড়ি যাও।
গেলেই হবে?
তার মানে?
শুধু হাতে গিয়ে মা কালীর মতো জিব বের করে দাঁড়াব নাকি মাগের সামনে? সে আমার ট্যাঁক দেখবে না? তবে যদি ঢুকতে দেয় ঘরে।
ভালো জ্বালা দেখছি।
আপনি ভালো লোক। সমীরণবাবু তো?
চিনলে কী করে?
গোবিন্দপুরে থাকেন, রায়বাড়ির ছোটোছেলে। সবাই জানে।
কী বলে জানে? বোকা না পাগল?
দুটোই। তা ওরকমধারাই ভালো। বোকা যদি না হতেন, ছিটিয়াল যদি না হতেন তা হলে আজ এই নয়ন। শর্মার কি প্রাণখানা থাকত দেহপিঞ্জরে?
কত চাই?
যা দেন। দশ বিশ।
খাঁই তো কম নয় দেখছি।
দশটা টাকা পেয়ে নয়ন সেলাম বাজিয়ে হাওয়া হল। তখন ভারি বোকা বোকা লাগল নিজেকে সমীরণের। ঠকে গেল নাকি? হিসেবটা সে করতে চায় না। আবার করেও ফেলে। কত ঠকল জীবনে?
ঠকেও সে। আবার পুরোপুরি ঠকেও না। এ, তিন বছর আগেকার কথা। নয়ন শর্মা এরপরে এসে, তাদের বাগানের বেড়া বেঁধে দিয়ে গেছে। গোয়ালঘর ছেয়ে দিয়ে গেছে। একটা কুড়ল আর একখানা বাটি চুরি করে নিয়ে গেছে। এই লেনদেন নিয়ে সংসার–সমীরণ যা বোঝে।
সে যে খানিক পাগল এটা সে জানে। আবার জানেও না। বাসুলি পুকুরে হরিমতিপিসির নারকোল তুলতে গিয়ে বিপদ হয়েছিল সেবার।
নারকোল বেচেই বুড়ির চলে। সেবার ঝড়বৃষ্টিতে মেলা নারকোল পড়ল জলে আর ডাঙায়। সমীরণ ফিরছিল তার তাঁতঘর থেকে। বুড়ি ধরে পড়ল, ও বাবা, নারকোল ক-টা তুলে দিয়ে যা। নইলে সব তুলে নিয়ে যাবে। যা হারামি সব ছেলেপুলেগুলো।
তা নেমেছিল সমীরণ। মোট কুড়িখানা নারকোল ডাঙায় ছুঁড়ে দিয়ে যখন উঠে আসছে তখনই মস্ত এক সাপ। ফণা তুলে সামনে দাঁড়ানো একেবারে নাগালের মধ্যে, মুখোমুখি।
বাঁচার উপায় অনেক ছিল। উলটে জলে পড়লেই হত। কিংবা হাতের একখানা নারকোল ছুঁড়ে মারলেও হতে পারত।
কিন্তু সমীরণের স্তম্ভনটা অন্য কারণে। সাপটা অদ্ভুত। বুকখানা টকটকে লাল। আর পিঠটা সাদা চিকরিমিকরি, এরকম অদ্ভুত সাপ, সে জন্মে দেখেনি। ভয় পাবে কী, সাপ দেখ সে মুগ্ধ। বিড়বিড় করে বলেও ফেলল, তুমি কী সুন্দর! কী সুন্দর!
কয়েক সেকেণ্ড ফণা তুলে দুলল সাপটা। সমীরণ দাঁড়িয়ে। শরীর ভেজা। টপটপ করে জল পড়ছে। বুকে একটুও ভয় নেই।
সাপটা তাকে দেখল কিছুক্ষণ। বোধহয়, বোকা আর পাগল বলে চিনতেও পারল। তাই হঠাৎ একটা শ্বাস ফেলে মাথাটা সরসর করে নামিয়ে ঘাসবনে অস্ত গেল।
কাউকে বলেনি সমীরণ। বললে লোকে বলবে, তুমি সত্যিই পাগল হে!
বাড়ি গিসগিস করছে লোকে। তাই সমীরণের জায়গা হয় না। আসলে একটু দাপুটে লোক হলে জায়গার। অভাব হয় না। কিন্তু সমীরণের মতো মুখচোরার দ্বারা তা হওয়ার নয়। নবীনদাদু মরার পর তার ঘরখানা সমীরণের পাওনা ছিল। কিন্তু গদাইকাকা এসে ঘরখানার দখল নিয়ে ফেলল, বলল, তুই একাবোকা মানুষ, তোর আস্ত একখানা ঘরের দরকারটা কী? যখন বিয়ে করবি তখন দেখা যাবে।
সমীরণ তাই একটু ফাঁকে থাকে। ঘর নয়। রাঙাকাকার ঘরের লাগোয়া দাওয়ার উত্তর দিকটা একটু বেড়া দিয়ে ঘিরে নিয়েছে। সেই ঠেকখানা তেমন মজবুত নয়। শীতের হাওয়া, গরমের হাওয়া দুই-ই ঢোকে, বৃষ্টির ছাঁট আসে, ব্যাং লাফায়, ইঁদুর দৌড়োয়, কুকুর, বেড়াল ঢুকে পড়ে। বেড়ালদের বাচ্চা দেওয়ার সময় হলে তারা আর কোথায় যাবে সমীরণের চৌকির তলা ছাড়া? সমীরণের বিয়ের উদ্যোগ হচ্ছে। সে ভাবে, বিয়ে না হয় হল, কিন্তু এই এক চিলতে ঘরে বউ আর সে, বড্ড ঘেঁষাঘেঁষি হবে না? তার ওপর এই একটা সরু চৌকি, রাতবিরেতে হয় তার ধাক্কায় বউ পড়ে যাবে, নয় তো বউয়ের ধাক্কায় সে। কী কেলেঙ্কারিটাই হবে তা হলে! ভালোমানুষের মেয়েকে কষ্ট দেওয়া বই তো নয়।
সকালবেলাটায় সমীরণের মনটা বেশ ভালো থাকে। আজও ছিল। সোনাজ্যাঠা এসে সেটা কেমন উলটে দিল। এসে ঘরের ভেতরে উঁকি মেরে দেখে নিয়ে নাক সিঁটকে বলল, এ ঘরটায় এমন মুতের গন্ধ কেন রে?
সমীরণ অবাক হয়ে বলল, নাকি?