নবদুর্গারও একটু শীত করছিল। সে অন্তি জ্যাঠাইমার দাওয়ায় পাতলা অন্ধকারে বসে চেয়ে রইল। গোবিন্দপুর কতদূর? যাবে কি সেখানে? সমীরণ নামটা কিন্তু বেশ।
দিঘির জলে সূর্য ডুবে গেল একটু আগে। পশ্চিমের আকাশে একটা ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতো মেঘ এসে শেষ আলোটুকুও পুঁছে দিচ্ছিল। এ-সময়ে নবদুর্গার কেন যে-রোজ কান্না পায়! রোজ পায়।
লছমির ডাক শোনা যাচ্ছে। একটু চমকে ওঠে নবদুর্গা। লছমি খুব কমই ডাকে। আজ ডাকছে কেন? জাবনার গামলার মধ্যে মুখ দিচ্ছে না তো! ঘাড় ফিরিয়ে ফিরিয়ে কাকে দেখছে যেন।
হঠাৎ নবদুর্গার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। রোজ সে লছমির সোহাগ পাওয়ার জন্য জাবনাটা নেড়ে দেয়। আজ দেয়নি। তাই কি খুঁজছে? যদি তাই হয়? ইস, আনন্দে বুকটার মধ্যে যেন একটা বাতাস বয়ে গেল।
নবদুর্গা এক ছুট্টে গিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, আমাকে খুঁজছিস, ও লছমি? আমাকে? ও আমার সোনালক্ষ্মী, ও আমার বুকের ধন…।
নবদুর্গা হাত দিল গামলার মধ্যে। আর কী আশ্চর্য ভগবান, এমনও হয় নাকি? লছমি একটা বড়শ্বাস ফেলে জানা খেতে লাগল মসমস করে।
নবদুর্গার চোখের জল বাঁধ মানল না। হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে বলল, তা হলে তুই আমাকে ভালোবাসিস লছমি! এত ভালোবাসিস?
কত সোহাগ হল দুজনে। এসব কেউ বুঝবে না। শুধু সে বোঝে–এসব অদ্ভুত আশ্চর্য আবিষ্কার।
রাত্রিবেলা যখন পাঠ শেষ করে ঘরে বসে জগাখুড়ো খই দুধে মেখে খাচ্ছে তখন গিয়ে তার ঘরে হানা দিল নবদুর্গা। জগাখুড়ো তার মস্ত অবলম্বন।
জগাখুড়ো, একটা কথা।
বল।
গোবিন্দপুর থেকে কাল আমাকে কারা দেখতে আসছে গো?
তা আসুক না।
শোনোনি?
আমাকে কি কেউ কিছু বলে? পড়ে আছি একধারে কুকুরটা-বেড়ালটার মতো।
এই জগাখুড়োই না-বলে, নরক কা মূল অভিমান!
কী হল গো তোমার খুড়ো?
জগাখুড়ো খইয়ের বড়ো বাটিটা মেঝের ওপর রেখে উদাস মুখে বলল, কী মনে হয় জানিস? মনে হয় বয়সকালে সংসারধর্ম করাই ভালো ছিল। তাতে তো আপনজন হত কয়েকজন। ওই দ্যাখ খই, দুধে কেমন মিশ খেয়ে গেছে। তেমনধারা মিশ খেতে পারলুম কই তোদের সংসারের সঙ্গে?
তুমি কি কালকের ঝগড়ার কথা কইছ খুড়ো? নগেনকাকা তো মাথাগরম মানুষ, সবাই তো জানে।
জগাখুড়োর সঙ্গে কাল নগেনকাকার লেগেছিল খুব। তেমন কিছু ব্যাপার নয়। নগেনকাকা তার ছেলে মদনকে খুব মারধর করছিল কাল, ঝড়পট্টিতে গিয়ে ভিডিয়ো দেখে রাত কাবার করে ফিরেছিল বলে। নগেনকাকার মার মানে পুলিশের মারকেও হার মানায়। মোটা বেতের লাঠি দিয়ে যখন মারে আর মদন যখন চেঁচায় তখন আশপাশে মানুষ থাকতে পারেন না। জগাখুড়ো গিয়ে তখন মাঝখানে পথে পড়েছিল। নগেনকাকার তাই রাগ, তুমি কে হে বারণ করার? আমি আমার ছেলেকে শাসন করছি, তুমি বলতে আসো। কেন? ভালোমানুষি দেখাতে এসো না, ছেলেটা যদি নষ্ট হয় তো তাতে তোমার তো ক্ষতি হবে না, হবে আমারই… তোমার আর কী… এইসব। গায়ে না মাখলেও চলে।
জগাখুড়ো খইয়ের বাটিটা ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল, মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, তোদের সংসার ছেড়ে হিমালয়ে চলে যাই।
তুমি গেলে আমি কাঁদব কিন্তু। ওরকম বলে না। কালকেই দেখো, মদনকাকা এসে তোমার কাছে গাঁইগুঁই করবে।
ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে জগাখুড়ো বলল, তা আর করতে হবে না। মনটাই আমার ভেঙে গেছে। তা কী বলতে এসেছিলি?
আগে খই-দুধ খাও, বলছি। বলে বাটিটা হাতে তুলে দেয় নবদুর্গা।
একটু চুপ করে থেকে জগাখুড়ো বলে, সংসারটা নরক।
আর নরক কা মূল অভিমান, তাই-না খুড়ো?
জগাখুড়ো ভ্রূ কুঁচকে বলে, কোথা থেকে শিখলি কথাটা?
যার কাছ থেকে শিখি। তুমি গো।
অ। পেকেছ খুব। বৃত্তান্তটা কী? গোবিন্দপুর তো?
হ্যাঁ! পাত্রের নাম সমীরণ। তারা কেমনধারা লোক?
তার আমি কী জানি?
.
২.
এ-কাজটা কার তা বলা কঠিন। হাটুরে ধুলোয় লোকটা পড়ে আছে। একটু আগে মুখ দিয়ে রক্ত আর গোঙানি বেরোচ্ছিল। এখন গোঙানিটা নেই। মরে গেল নাকি? না :, শ্বাস চলছে।
যারা মেরেছিল তারা এখন তফাত হয়েছে। সে চারদিকটা দেখে নিল একবার। নীলুদাদু কি সাধে বলে, লোকের ভালো করতে নেই। যতবার ভালো করতে গেছে সে, ততবারই গন্ডগোল হয়েছে। তবু এই ভালোটা না করেও সে পারে না। লোকটা চোর এবং পাকা চোর। মার কি আর এমনি খায়? লোকে খেটেপিটে রোজগার করে আর এ-ব্যাটা ফাঁকতালে। তবে এরও হয়তো বালবাচ্চা, এন্ডিগেন্ডি, বাপ মা আছে। এটাই কষ্টের। চোর গুণ্ডা খুনে যা-ই হোক–তাদেরও জন থাকে। জনগুলোরই কষ্ট।
লোকটাকে কাঁধে তুলেই ফেলল সে। খুব ভারী মানুষ নয়। কাঁধে দো-ভাঁজ চাদরের মতো নেতিয়ে পড়ল। কুমোরপাড়া পেরোলেই সাউ ডাক্তারের ঘর।
ডাক্তারবাবু,–আছেন নাকি?
ডাক্তার আছে। আজ হাটবার, মেলা রুগি। এ-দিনটা সাউ সেঁটে থাকে।
কে রে?
আজ্ঞে আমি, সমীরণ।
সাউ মুখ বেঁকাল, অ তা কী মনে করে? কাঁধে আবার কোন গন্ধমাদন বয়ে আনলে বাপু?
এ-ব্যাটা হাটুরে ঠ্যাঙানি খেয়েছে। বাঁচবে কি না দেখে দিন তো!
ও বাবা, ও আপদ বিদেয় করে এসো। হাটের জিনিস হাটেই পড়ে থাকত বাবা, বয়ে আনার কী ছিল? কলজের জোর থাকলে হাওয়া-বাতাসেই আরাম হবে, ওষুধ লাগে না ওদের।
একটু দেখে দিন তবু।
ভিজিটটা দেবে কে?
দেওয়া যাবে।
কেন যে বাপু, এসব ঝামেলায় আমাকে জড়াও। সদ্য চেম্বার বন্ধ করতে যাচ্ছিলাম…