দুধেভরা পেতলের বালতিটা নারুদার হাত থেকে নিতে নিতে কে জানে কেন, নবদুর্গা বলে ফেলল, তুমি। খুব ভালো লোক নারুদাদা।
নারু হেসে লজ্জার ভাব করে বলে, শোনো কথা। আমরা কেমন করে ভালো লোক হতে পারি বলো। আমাদের কী জ্ঞান আছে? অজ্ঞানী যে বড্ড।
তুমি নিশ্চয়ই ভালো লোক, নইলে কি লছমি তোমাকে অত ভালোবাসত?
এটা কোনো কথা হল নবদিদি? গোরু দিয়ে কি মানুষ চেনা যায়? তোমার যেমন কথা!
খেলুড়িরা সব জামতলায়। পেতলের বালতিটা ভাঁড়ার ঘরে মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে নবদুর্গা বলল, খেলতে যাচ্ছি মা!
দিন-রাত খেলা আর খেলা। কীসের খেলা রে? ধিঙ্গি ধিঙ্গি মেয়েরা বসে বসে কেবল গুজগুজ ফুসফুস। ওটা খেলা নাকি?
কথাটা মিথ্যে নয়। আজকাল তারা একটু পেকেছে। আগে যেমন পুতুল-খেলা, এক্কা-দোক্কা, চোর-চোর, গোল্লাছুট ছিল এখন আর তেমনটি ইচ্ছে যায় না। বসে বসে গল্প করতেই ভালো লাগে। হ্যাঁ বটে, তার মধ্যে। আজকাল রসের কথাও কিছু থাকছে।
সে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, যাই-না মা!
মা একবার কঠিন চোখে তার দিকে চেয়ে বলল, কাল তোমাকে দেখতে আসছে গোবিন্দপুরের লোকেরা। কথাটা মনে রেখো। শেফালিকে বলে দে, কাল সকালে নাপতেবুড়ি এসে যেন, তোর পা ঝামা ঘষে পরিষ্কার করে দিয়ে যায়, আর বিকেল বিকেল এসে খোঁপা বেঁধে দিয়ে যাবে।
পাত্রপক্ষের কথা নবদুর্গা জানে। এর আগেও দুটো পক্ষ এসে দেখে গেছে। এক পক্ষ পছন্দই করেনি, আর এক পক্ষ পছন্দ করলেও দেনা-পাওনায় মেলেনি।
বিয়ের কথা ভাবতে যে তার ইচ্ছে হয় না তা নয়। কিন্তু ওই যে, একলাটি সে এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, অচেনা এক মানুষ আঁচলে গেরো দিয়ে টেনে নিয়ে যাবে তাকে, এ-কথা ভাবলে বুকে একটা কষ্ট হয়। মা, বাবা, ভাই, বোন, খেলুড়ি বন্ধুরা, ভুলো কুকুর কিংবা টেনি বেড়াল, এই গাঁ, ওই ষষ্ঠীতলা, আর ওই যে মিষ্টি তেঁতুলের ঝিরিঝিরি ছায়া, লছমি বা রাঙা গাই, এদের সবাইকে ফেলে যেতে হবে তো। তার কাছে এরা সবাই মানুষের মতো। এমনকী বেড়াল, কুকুর, গাছ, গাঁ সব সব সব। এদের ছেড়ে গিয়ে সে কি বাঁচবে?।
মায়ের যখন মেজাজ ভালো থাকে, তখন মা বলে, বাঁচবি। মেয়ে হয়ে জন্মেছিস তো পরের ঘরের জন্যই। এজন্যই তো মেয়ে দিয়ে বংশরক্ষা হয় না। না বাঁচে কে বল তো! এই যে, আমি কেমন বেঁচে আছি দেখছিস না। সব ছেড়ে আসিনি আমি? আবার সব পেয়েছিও তো!
সাঁঝবেলাতে এমনিতেই মন একটু খারাপ হয়। পাত্রপক্ষের কথা শুনে আরও একটু হল। গোবিন্দপুর কেমন গাঁ কে জানে! সেখানে হয়তো সবাই গোমড়ামুখো, সবাই রাগি। কে জানে কী!
খেলুড়িরা গোল হয়ে বসেছিল। নবদুর্গা কাছে যেতেই চারি বলল, বাব্বাঃ রে বাব্বাঃ! কতক্ষণ বসে আছি তোর জন্য। এই তোর আসার সময় হল? ধুস, আমার কিছু ভালো লাগছে না।
কেন, কী আবার হল?
কারা যেন দেখতে আসবে কাল।
পটলি একটু কম কথা কয়। সে ভারি ভালমানুষ। খুব ছোটোখাটো, রোগা আর কালো। ফস করে বলে উঠল, আমি জানি।
কী জানিস রে?
গোবিন্দুপুরে আমার জ্যেঠতুতো দিদির শ্বশুরবাড়ি। দিদি আজই এল সকালে। মাকে বলছিল ওখানে সমীরণ না কে একটা ছেলে আছে, তার সঙ্গে তোর সম্বন্ধ।
সমীরণ নামটা খুব একটা খারাপ লাগল না নবদুর্গার। ঠোঁট উলটে অবশ্য বলল, বয়েই গেছে বিয়ে করতে। পটলি বলল, দিদি বলছিল নাকি পাগলা মানুষ।
বলিস কী? বলে সবাই চমকে উঠল।
হিহি করে হাসল পটলি, পাগলা বলতে তেমন নয় কিন্তু। খেয়ালি।
তার মানে কী? বিড়বিড় করে নাকি?
সে আমি জানি না। দিদি বলছিল, ছেলে নাকি মন্দ নয়।
চটারি বলল, কেমন দেখতে? মুশকো, কালো, ঝাঁটা গোঁফ নাকি?
তা কে জানে? অত শুনিনি।
নবদুর্গা বলল, তাই হবে। আমার কপালে কী ভালো কিছু জুটবে?
মান্তু বলল, কেন বাবা, তোর কপালটা এমন কী খারাপ? আমাদের মতো তো তোর গরিব-ঘর নয়। দশ বিশ হাজার টাকা খরচ করতে পারে জ্যাঠামশাই, আমার বাবা পারবে?
কয়েক মাস আগে লোহাগঞ্জের মস্ত এক পরিবারে মান্তুর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। দশ হাজার টাকা পণের জন্য ভেস্তে যায়।
মাস্তুর মুখখানা দেখে ভারি কষ্ট হল নবদুর্গার। গরিব-ঘরের হলেও মান্তু দেখতে বেশ। বড়ো বড়ো চোখ, রংটাও ফর্সার দিকে, ভারি ঢলঢলে মুখ। ভালো ঘরেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল প্রায়। মান্তুর বাবা হরিপদ ধারকর্জের চেষ্টাও করছিল কম নয়। পায়নি।
মান্তুর কথাটার পরই আজকের জমায়েতটার কেমন যেন তাল কেটে গেল। কারো আর কথা আসছিল না। তাদের যা বয়েস এখন, তাতে সকলেরই দিন আসছে। কার ভালো বিয়ে হবে, কার খারাপ তা যেন রথের মেলায় মোয়াওয়ালা ফটিকের ঘুরণচাকি। পঞ্চাশটা পয়সা ফেললেই ফটিক তার চাকির কাঁটা, বাঁই করে ঘুরিয়ে দেবে। চাকির গায়ে নম্বর লেখা। কাঁটা যে ঘরে থামবে ততটা মোয়া। কারো ভাগ্যে দশও ওঠে, কারো ভাগ্যে। শূন্য। বিয়েটাও হল তাই। আর সেজন্যই তাদের বুকে একটা গোপন দুরদুরুনি আছে। মাঝে মাঝে যেন শ্বাসকষ্ট হয়।
আজ জোরদার পাঠ হচ্ছে জগাখুড়োর দাওয়ায়। দশ-বারোজন জুটেছে। খেলুড়িরা একে একে চলে যাওয়ার পর জামতলা থেকে ফেরার সময়ে দৃশ্যটা দেখতে পেল নবদুর্গা। একখানা পেতলের ঝকঝকে হ্যারিকেন জ্বেলে নিয়ে বসেছে জগাখুড়ো। যাই-যাই শীত। খুড়োর গায়ে নস্যি রঙের ব্যাপার।