কাল শিবরাত্রির উপোস গেছে। আজ নবদুর্গার শরীর ভারী দুর্বল। সকালে কাঁচা মুগ ভেজানো গুড় দিয়ে খেয়েছে আর মিছরির শরবত। শরীর নয়, মনটাই যেন আজ তেমনধারা। শিবরাত্রি করে কী হয়? কচু হয়? কিছু হয় না। ন’বছর বয়স থেকে শিবরাত্রি করে আসছে সে। কিছু হল?
জগা খুড়ো এল বেটান’টা নাগাদ।
আছিস নাকি ঘরে?
আছি গো, কেন?
শরীর খারাপ নাকি?
ব্রত করলাম না?
ও, তাই তো বটে!
জগা খুড়োর মুখে কেমন যেন বোকা–বোকা হাসি। মাথাটাথা চুলকে বলল , ওই একটা ব্যাপার হয়েছে।
কী ব্যাপার খুড়ো?
বাড়ির লোক টের পেলে কী করবে কে জানে।
ভয় খেয়ে নবদুর্গা উঠে বসল। তার যে বুক দুরদুর করছে!
কী হল খুড়ো?
আমার ঘরটায় একবার যা। একজন এসে বসে আছে। বড় দুঃখী মানুষ।
কে গো?
যা না। দেখে যদি বুঝতে পারিস তবেই হয়। যা একবার।
নবদুর্গার বুকের মধ্যে কেমন যেন আছাড়ি পিছাড়ি ভাব। বড্ড মোচড় দিচ্ছে পেটের মধ্যে। মুখ শুকিয়ে কাঠ। সে তবু উঠল।
খুড়োর ঘর পর্যন্ত যেতে উঠোনটা যেত তেপান্তরের মাঠ। সিঁড়ি মোটে এক ধাপ। তাও পেরোতে যেন হাঁটু ভেঙে এল। ঘরের দাওয়ায় উঠে দরজা অবধি যেন যেতেই পারছিল না। দরজায় থমকে গেল।
একে সে এ জন্মে দেখেনি ঠিক। কিন্তু এ তার সাত জন্মের চেনা। এ কি আজকের?
অপরাধী একজোড়া চোখ তুলে সে চাইল। তারপর তার চোখও পলকহীন। চিনেছে কি?
হ্যাঁ চিনেছে। সেই চেনার ঝিকিমিকি চোখে উথলে উঠল।
নবদুর্গা একটু হেসে মাথা নোয়াল।
দুজনের কোনও কথা হল না। শুধু আড়াল থেকে জগা খুড়োর মৃদু গলা খাঁকারির একটা শব্দ হল। উঠোনের ওধার থেকে লছমী হঠাৎ ডেকে উঠল অকারণে। কিংবা কে জানে তত অকারণে হয়তো নয়।
নবদুর্গা
গোরু দুইতে নারু আসছে ওই যে। বৈষ্ণবদিঘির পার দিয়ে বাঁশতলা পেরিয়ে। ভারি সুন্দর জায়গা ওটা। মিষ্টি তেঁতুলের একটা সার আছে ওখানে। সে ভারি সুন্দর তেঁতুল, পাকলেই মিষ্টি। কিন্তু সেটা বড়োকথা নয়। এই বিকেলের দিকে গড়ানে রোদ্দুরের আলোয় ওই তেঁতুলবনে যে আলোছায়ার চিকরিমিকরি তৈরি করে তা যেন রূপকথার মতো।
এ বাড়ির সবাই গোরু দুইতে পারে। তবু নারুকে আসতে হয় লছমির জন্য। ভারি দুষ্টু গোরু। জগাখুড়ো বলে, বাপরে, ও হল লাথ মারুয়া গোরু, ওর কাছে যেতে আছে? অথচ লছমি দুধ দেয় এককাঁড়ি। আবার লাথি বা ঢুঁসো মারতেও কসুর করে না। নারু খুব যত্ন করে লছমির পেছনের পা দুটো গামছা দিয়ে বাঁধে। তারপর পেতলের বালতিতে চ্যাংচুং শব্দে দুধ দোয়ায়। লছমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, একটুও দুষ্টুমি করে না।
আচ্ছা নারুদাদা, তোমাকে কি লছমি ভয় পায়?
নারু হাসে। বলে, না রে পাগলি, ভয় পাবে কেন? ও আমাকে ভালোবাসে।
তা তোমাকেই বাসে, আর আমাদের বাসে না কেন? আমরা তো ওকে খড়-বিচালি দিই, জাবনা দিই, ভাতের ফ্যান, তরকারির খোসা খাওয়াই, কত আদর করি গলকম্বলে হাত বুলিয়ে।
কোনো কোনো গোরু ওরকম হয়।
জগাখুড়ো বলে, তুমি নাকি মন্তরতন্তর জানো।
খুব হাসে নারু, শোনো কথা। মন্তরতন্তর কোথা থেকে জানব? আমাদের কি তত ক্ষমতা আছে? জগাখুড়ো হল মাথা-পাগলা মানুষ, কত কী বলে।
নবদুর্গার খুব ইচ্ছে করে লছমির সঙ্গে ভাব করতে। ইচ্ছে হবে না-ই বা কেন? কী সুন্দর দেখতে লছমি। দুধসাদা রঙের ওপর কালো ছোপ। তেমনি মায়াবী দুখানা চোখ। বলতে নেই, লছমি বেশ বড়োসড়ো গোরু, তেজও তেমনি। নবদুর্গার সঙ্গে কি তা বলে লছমির ভাব নেই? আছে। লছমি যখন মাটির কালো গামলায় জাবনা খায় তখন তো নবদুর্গাই জাবনা নেড়েচেড়ে দেয়। তখন গলায় হাত বোলালে লছমি ভারি আরাম পায়। কিন্তু তাদের অন্য আর পাঁচটা গোরু যেমন মাটির মানুষ আর বাধ্যের মানুষ, ডাকলেই কাছে আসে, লছমি। তেমনটি নয়। আর এই যে নারুদার ওপর লছমির একটু পক্ষপাত, এতেও নবদুর্গার হিংসে আছে। হিংসে হবে না বলো! এত ভালোবাসে সে লছমিকে, আর লছমি কিনা অমন!
নবদুর্গার একটু হিংসেটিংসে আছে বাপু। ওই যে তার খেলুড়ি বন্ধুরা এসে জামতলায় জড়ো হয়েছে, ওদের মধ্যে যেমন তোটন আর রমলা তার খুব বন্ধু, অন্যরা কি তেমন? তোটনের সঙ্গে পুষ্পর যদি বেশি ভাব দেখতে পায় নবদুর্গা তবে তার হিংসে হয়। কেন তা কে বলবে?
তোটন অবশ্য বলে, তোর একটুতেই বড় গাল ফোলে।
তা ফোলে বাপু, নবদুর্গা মিথ্যে কথা বলতে পারবে না।
জগাখুড়ো ওই যে বসে আছে তার দাওয়ার এক কোণটিতে। নবদুর্গাদের মস্ত উঠোন। তাও একটা নয়, চারখানা। বেশির ভাগই মাটির ঘর। একতলাও আছে, দোতলাও আছে। হালে একখানা পাকা দোতলাও উঠেছে ওই ধারে। জগাখুড়ো এ বাড়ির কেউ নয়, আছে মাত্র। তিন কুলে কেউ নেই। ঘরে বসে নানারকম কিম্ভুত ওষুধ, আচার এসব বানায় আর ধর্মের বই পড়ে। এই যে বিকেলটি হয়ে আসছে, এই সময়টায় জগাখুঁড়ো এসে দাওয়ায় বসবে মাদুর পেতে। সামনে একখানা জলচৌকি, কত কী পাঠ করে সুরেলা গলায়। সন্ধের পর জগাখুড়োকে ঘিরে বাড়ি আর পাড়ার বউ-ঝি আর বুড়ো-বুড়িদের জমায়েত হয়। জগাখুড়ো একদিন তাকে বলেছিল, নরক কা মূল অভিমান। তোর অত কথায় কথায় গাল ফোলে কেন রে? ওরকমটা ভালো নয়।
তা কী করবে নবদুর্গা? তার যে হয়। নরক কা মূল অভিমান–কথাটা মনে হলে তার একটু ভয়ও হয়। তার যে কথায় কথায় গাল ফোলে ভগবান? তবে কি নরকেই যেতে হবে তাকে? মাগো! বাজিতপুরের হাটে নরকের একখানা বড়োপট দেখেছিল নবদুর্গা। পাজি মেয়েদের কী দুরবস্থা বাবা! ফুটন্ত হাঁড়িতে ফেলছে। একজনাকে তো অন্যজনাকে চুলের মুঠি ধরে গদা নিয়ে পেটাচ্ছে। একজনকে তো ন্যাংটো করে–মাগো!