কিন্তু সমীরণের স্তম্ভনটা অন্য কারণে। সাপটা অদ্ভুত। বুকখানা টকটকে লাল। আর পিঠটা সাদা চিকরিমিকরি, এরকম অদ্ভুত সাপ সে জন্মে দেখেনি। ভয় পাবে কি, সাপ দেখে সে মুগ্ধ। বিড়বিড় করে বলেও ফেলল, তুমি কী সুন্দর! কী সুন্দর!
কয়েক সেকেন্ড ফণা তুলে দুলল সাপটা। সমীরণ দাঁড়িয়ে। শরীর ভেজা। টপটপ করে জল পড়ছে। বুকে একটুও ভয় নেই।
সাপটা তাকে দেখল কিছুক্ষণ। বোধহয় বোকা আর পাগল বলে চিনতেও পারল। তাই হঠাৎ একটা শ্বাস ফেলে মাথাটা সরসর করে নামিয়ে ঘাসবনে অস্ত গেল।
কাউকে বলেনি সমীরণ। বললে লোকে বলবে, তুমি সত্যিই পাগল হে।
বাড়ি গিসগিস করছে লোকে। তাই সমীরণের জায়গা হয় না। আসলে একটু দাপের লোক হলে জায়গায় অভাব হয় না। কিন্তু সমীরণের মতো মুখচোরার দ্বারা তা হওয়ার নয়। নবীনদাদু মরার পর তার ঘরখানা সমীরণের পাওনা ছিল। কিন্তু গদাইকাকা এসে ঘরখানার দখল নিয়ে ফেলল, বলল , তুই একাবোকা মানুষ, তোর আস্ত একখানা ঘরের দরকারটা কী? যখন বিয়ে করবি তখন দেখা যাবে।
সমীরণ তাই একটু ফাঁকে থাকে। ঘর নয়। রাঙাকাকার ঘরের লাগোয়া দাওয়ার উত্তর দিকটা একটু বেড়া দিয়ে ঘিরে নিয়েছে। সেই ঠেকখানা তেমন মজবুত নয়। শীতের হাওয়া, গরমের হাওয়া দুইই ঢোকে, বৃষ্টির ছাঁট আসে, ব্যাং লাফায়, ইঁদুর দৌড়োয়, কুকুর বেড়াল ঢুকে পড়ে। বেড়ালদের বাচ্চা দেওয়ার সময় হলে তারা আর কোথায় যাবে সমীরণের চৌকির তলা ছাড়া? সমীরণের বিয়ের উদ্যোগ হচ্ছে। সে ভাবে, বিয়ে না হয় হল, কিন্তু এই এক চিলতে ঘরে বউ আর সে বড্ড ঘেঁষাঘেষি হবে না? তার ওপর ওই একটা সরু চৌকি, রাতবিরেতে হয় তার ধাক্কায় বউ পড়ে যাবে, নয় তো বউয়ের ধাক্কায় সে। কী কেলেঙ্কারিটাই হবে তা হলে! ভালোমানুষের মেয়েকে কষ্ট দেওয়া বই তো নয়।
সকালবেলাটায় সমীরণের মনটা বেশ ভালো থাকে। আজও ছিল। সোনাজ্যাঠা এসে সেটা কেমন উলটে দিল। এসে ঘরের ভিতরে উঁকি মেরে দেখে নিয়ে নাক সিঁটকে বলল , এ ঘরটায় এমন মুতের গন্ধ কেন রে?
সমীরণ অবাক হয়ে বলল , নাকি?
নয়? তোর তো দেখছি তুরীয় অবস্থা, মুতের গন্ধ পায় না এমন আহাম্মক কে?
সমীরণ ভারী কাঁচুমাচু হল। মুতের গন্ধের দোষ কী? মোতি নামের বেড়ালটার প্রসব হয়েছে কদিন। চৌকির তলায় তার আঁতুরঘর। অপকর্মটা হয়তো মোতিই করে। কে জানে বাবা।
নবাবগঞ্জের মেয়েটা বাতিল হয়ে গেল, বুঝলি!
বুঝল না সমীরণ। বলল , কোন মেয়ে?
আমার খুব পছন্দ ছিল। গণেশদাদাও বলছিল দুর্গাপ্রতিমার মতো দেখতে। কিন্তু সেজবউ বলল , মেয়ের খুঁত আছে। কী খুঁত তা ভেঙে বলল না। মেয়েলি ব্যাপার, কে জানে বাবা কী। মোটমাট বাতিল।
ও। আচ্ছা। সমীরণ এর বেশি আর কী বলবে?
সমীরণ চেয়ে রইল।
ও মেয়ে দেখার পর সেজবউ ভয় পেয়েছে, সুন্দরী বলে তার যে গ্ল্যামার ছিল তা এবার যাবে। নবদুর্গা এলে তাকে কেউ ফিরেও দেখবে না। তা বলে মুখের ওপর অমন কটমট করে কথা না শোনালেও পারত।
কী কথা জ্যাঠা।
এই হেনতেন, মেয়েদের অনেক কায়দা জানা আছে। বিঁধিয়ে–বিধিয়ে এমন বলে। মেয়েটা ভারী দুঃখ পেল।
সমীরণ একটু বিষণ্ণ হল। মুখের ওপর কাউকে বাতিল করা কি ভালো?
তুই মুতের গন্ধ পাস না কেন রে? এঃ বাবা, নাক যে জ্বালা করছে।
সমীরণ পায় না তা কী করবে। ভারী দুঃখী হয়ে সে বসে রইল। হোক মুতের গন্ধ, তা বলে কি সে মোতিকে বাচ্চাসমেত ঘরের বার করতে পারে? সমীরণ অনেক কিছুই পারে না যা পারা। উচিত।
তাঁতঘরে আজ সারাদিন ভারি আনমনা রইল সমীরণ। অন্যদিন তাঁতের শব্দ তার সঙ্গে নানা কথা বলে। শুনলে লোকে তাকে আরও পাগল বলবে বলে সে কথাটা কাউকে বলে না। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি তাঁতের সঙ্গে তার নানা কথা হয়। তাঁতও তার কথা বুঝতে পারে, সেও বোঝে তাঁতের ভাষা।
আজ তাঁত বলল , পরশু শিবরাত্রি।
হ্যাঁ, তা জানি, তাতে কী?
জানো? ভালো। এই বলছিলাম আর কি, শিবরাত্রি ভারী ভালো দিন।
অ। তা হবে। আজ আমার মনটা ভালো নেই।
ভালো না থাকারই কথা। বলি কি শিবরাত্রির দিনই গিয়ে নবাবগঞ্জে হানা দাও। মেয়েটার কাছে ক্ষমা চেয়ে নাও।
যাব?
যাও। খুঁতো মেয়ে বলছে, তা খুঁতো নয় কে? সবাই খুঁতো।
সমীরণ একটা শ্বাস ফেলল। বলল , দুনিয়াটা কেমনধারা বলো তো!
তোমার জায়গা নয় হে এটা। তুমি হলে পাগল আর বোকা।
তা তো জানি।
ওরকমই থাকো। অন্যরম হওয়ার কথা নয় তোমার। ঠাকুর যেমনটি করেছেন তোমায় তেমনটিই থাকো।
৩.
জগা খুড়ো এসে বলেছিল, তোর কপালে হলে হয়। ছেলে পাগল ঠিকই, বোকাও হয়তো, কিন্তু ভগবান কাউকে কাউকে পাঠান। এ তার নিজের লোক।
পাগল আর বোকা! মাগো!
জগা খুড়ো যেন কেমনধারা পাগুলে চোখে আনমনা চেয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলল , সংসারী হিসেবে সে এমন কিছু আহামরি নয়। তবে অন্য একটা হিসেবও তো আছে। অন্য হিসেব
এই অন্য হিসেবটা বোঝে না নবদুর্গা। সে তো সংসারী মানুষ, বুঝবে কী করে? আবার তার মনটা মাঝে-মাঝে ভারী অন্যরকম, তখন সে ঠিক সংসারী থাকে না। তখন তারও হিসেব উলটেপালটে যায়।
গোবিন্দপুরের লোকেরা এসেছিল। তাকে নাকচ করে গেছে মুখের ওপরেই। ভগবানের লোকের সঙ্গে তার বিয়েটা হচ্ছে না। একটা বউ এসেছিল তাদের সঙ্গে দেখতে ভারী ঢলঢলে। কিন্তু জিবের যা ধার। মিষ্টি–মিষ্টি করে এমন সবকথা বলল , রংটা তো তেমন নয়, চুলের গোছ কী আর ভালো, দাঁতগুলো অমন কেন, পান খাও নাকি? পোকা নয় তো! খ্যামোকা কথা সব। বলতে হয় বলে বলা।