জগা খুড়ো খইয়ের বাটিটা ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল , মাঝে-মাঝে ইচ্ছে হয় তোদের সংসার ছেড়ে হিমালয়ে চলে যাই।
তুমি গেলে আমি কাঁদব কিন্তু। ওরকম বলে না। কালকেই দ্যাখো, মদনকাকা এসে তোমার কাছে গাঁইগুই করবে।
ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে জগা খুড়ো বলল , তা আর করতে হবে না। মনটাই আমার ভেঙে গেছে। তাকী বলতে এসেছিলি?
আগে খই–দুধ খাও, বলছি। বলে বাটিটা হাতে তুলে দেয় নবদুর্গা। একটু চুপ করে থেকে জগা খুড়ো বলে, সংসারটানরক। আর নরক কা মূল অভিমান, তাইনা খুড়ো?
জগা খুড়ো ভ্রূ কুঁচকে বলে, কোথা থেকে শিখলি কথাটা?
যার কাছ থেকে শিখি। তুমি গো।
অ। পেকেছ খুব। বৃত্তান্তটা কী? গোবিন্দপুর তো?
হ্যাঁ। পাত্রের নাম সমীরণ। তারা কেমনধারা লোক?
তার আমি কী জানি?
২.
এ কাজটা কার তা বলা কঠিন। হাটুরে ধুলোয় লোকটা পড়ে আছে। একটু আগে মুখ দিয়ে রক্ত আর গোঙানি বেরোচ্ছিল। এখন গোঙানিটা নেই। মরে গেল নাকি? নাঃ, শ্বাস চলছে।
যারা মেরেছিল তারা এখন তফাত হয়েছে। সে চারদিকটা দেখে নিল একবার। নীলুদাদু কি সাধে বলে, লোকের ভালো করতে নেই। যতবার ভালো করতে গেছে সে ততবারই গণ্ডগোল হয়েছে। তবু এই ভালোটা না করেও সে পারে না। লোকটা চোর এবং পাকা চোর। মার কি আর এমনি খায়? লোকে খেটেপিটে রোজগার করে আর এ ব্যাটা ফাঁকতালে। তবে এরও হয়তো বালবাচ্চা এণ্ডিগেণ্ডি, বাপ মা আছে। এটাই কষ্টের। চোর গুন্ডা খুনে যা-ই হোক–তাদেরও জন থাকে। জনগুলোরই কষ্ট।
লোকটাকে কাঁধে তুলেই ফেলল সে। খুব ভারী মানুষ নয়। কাঁধে দো ভাঁজ চাদরের মতো নেতিয়ে পড়ল। কুমোরপাড়া পেরোলেই সাউ ডাক্তারের ঘর।
ডাক্তারবাবু, আছেন নাকি?
ডাক্তার আছে। আজ হাটবার, মেলা রুগি। এ দিনটা সাউ সেঁটে থাকে।
কে রে?
আজ্ঞে আমি, সমীরণ।
সাউ মুখ বেঁকাল, অ। তাকী মনে করে? কাঁধে আবার কোন গন্ধমাদন বয়ে আনলে বাপ?
এ ব্যাটা হাটুরে ঠ্যাঙানি খেয়েছে। বাঁচবে কি না দেখে দিন তো!
ও বাবা, ও আপদ বিদেয় করে এসো। হাটের জিনিস হাটেই পড়ে থাকত বাবা, বয়ে আনার কী ছিল? কলজের জোর থাকলে হাওয়া বাতাসেই আরাম হবে, ওষুধ লাগে না ওদের।
একটু দেখে দিন তবু।
ভিজিটটা দেবে কে?
দেওয়া যাবে।
কেন যে বাপু এ সব ঝামেলায় আমাকে জড়াও। সদ্য চেম্বার বন্ধ করতে যাচ্ছিলাম…গজগজ করতে-করতে ডাক্তার সাউ লোকটাকে দেখল। দেখতে-দেখতে বলল , বলেছি না এ শালা বেজম্মাদের ওষুধ লাগে না। দিব্যি বেঁচে আছে। মারের চোটে ভিরমি খেলেও কিছু নয়। টিকে যাবে। নিয়ে যাও।
একটু ওষুধ–টসুধ দেবেন না?
পয়সা?
হবে।
দ্যাখো বাপু। বাকি কারবারে ফেলোনা। অনেক ভিজিট মার গেছে আমার জীবনে।
তা ওষুধ হল, পট্টি লাগানো হল। লোকটা একটু ঘোলা চোখে চাইলও।
সমীরণ বারোটা টাকা হিসেবমতো দিয়ে দিল। তারপর লোকটাকে দাঁড় করিয়ে বলল , চল ব্যাটা। বেঁচে গেছিস।
লোকটা টলতে টলতে বেরিয়ে এল সঙ্গে-সঙ্গে।
কুমোরপাড়ার রাস্তায় পড়ে লোকটা সটান হল। বলল , বাবু কি আমাকে পুলিশে দিচ্ছেন?
দেওয়াই উচিত।
ও শালা পুঙ্গির ভাইয়েরা যে পেটাল ওদের কী করছেন?
হাটসুষ্ঠু কি পুলিশ দেওয়া যায়? বেশ করেছে মেরেছে।
বেশ করা আমিও বের করে দেব, দেখবেন। বনমালীর দোকান থেকে–বললে বিশ্বেস করবেন না-মোটে পাঁচটা টাকা কুড়িয়েছি তাইতেই ওই কাণ্ড।
কুড়িয়েছ মানে?
বনমালী ক্যাশবাক্স খুলে টাকা খাবলে কাকে যেন খুচরো ফেরত দিতে যাচ্ছিল, পাঁচ টাকার নোটটা উড়ে এসে পড়ে মাটিতে। সেইটে কুড়িয়ে গস্ত করায় এই হেনস্থা।
তুমি চোর নও তা হলে?
কোন শালা নয়। সব চোর। হাটে বাজারে পথেঘাটে দাঁড়িয়ে যে দিকে তাকাব সব চোর।
জানি। বাড়ি যাও।
গেলেই হবে?
তার মানে?
শুধু হাতে গিয়ে মা কালীর মতো জিব বের করে দাঁড়াব নাকি মাগের সামনে? সে আমার ট্যাঁক দেখবে না? তবে যদি ঢুকতে দেয় ঘরে।
ভালো জ্বালা দেখছি।
আপনি ভালো লোক। সমীরণবাবু তো!
চিনলে কী করে?
গোবিন্দপুরে থাকেন, রায়বাড়ির ছোট ছেলে। সবাই জানে।
কী বলে জানে? বোকা না পাগল?
দুটোই। তা ওরকমধারাই ভালো। বোকা যদি না হতেন, ছিটিয়াল যদি না হতেন তা হলে আজ এই রকম শর্মার কি প্রাণখানা থাকত দেহপিঞ্জরে?
কত চাই?
যা দেন। দশ-বিশ।
খাঁই তো কম নয় দেখছি।
দশটা টাকা পেয়ে নয়ন সেলাম বাজিয়ে হাওয়া হল। তখন ভারী বোকা–বোকা লাগল। নিজেকে সমীরণের। ঠকে গেল নাকি? হিসেবটা সে করতে চায় না। আবার করেও ফেলে। কত ঠকল জীবনে?
ঠকেও সে। আবার পুরোপুরি ঠকেও না। এ তিন বছর আগেকার কথা। নয়ন শর্মা এর পরে, তাদের বাগানের বেড়া বেঁধে দিয়ে গেছে। গোয়ালঘর ছেয়ে দিয়ে গেছে। একটা কুড়ুল আর একখানা বাটি চুরি করে নিয়ে গেছে। এই লেনদেন নিয়ে সংসারসমীরণ যা বোঝে।
সে যে খানিক পাগল এটা সে জানে। আবার জানেও না। বাসুলি পুকুরে হরিমতিপিসির নারকোল তুলতে গিয়ে বিপদ হয়েছিল সেবার।
নারকোল বেচেই বুড়ির চলে। সেবার ঝড়বৃষ্টিতে মেলা নারকোল পড়ল জলে আর ডাঙায়। সমীরণ ফিরছিল তার তাঁতঘর থেকে। বুড়ি ধরে পড়ল, ও বাবা, নারকোল কটা তুলে দিয়ে যা। নইলে সব তুলে নিয়ে যাবে। যা হারামি সব ছেলেপুলেগুলো।
তা নেমেছিল সমীরণ। মোট কুড়িখানা নারকোল ডাঙায় ছুঁড়ে দিয়ে যখন উঠে আসছে তখনই মস্ত এক সাপ। ফণা তুলে সামনে দাঁড়ানো। একেবারে নাগালের মধ্যে, মুখোমুখি। বাঁচার উপায় অনেক ছিল। উলটে জলে পড়লেই হত। কিংবা হাতের একখানা নারকোল ছুঁড়ে মারলেও হতে পারত।