তারপর অনেক রাতে ভিনি আমাকে তার জন্মদাগ দেখতে দিয়েছিল।
তিন বছরে আমাদের দুটি ছেলেমেয়ে হল। আর আমরা অল্প একটু বুড়ো হয়ে গেলুম।
মাঝে-মাঝে আমি ভিনিকে বলি–ভিনি, আমার মন ভালো নেই।
–কেন?
–কি জানি।
–শরীর খারাপ নয়তো? বলতে-বলতে সে এসে আমার কপালে তার গাল ছোঁয়ায়, বুকে হাত দিয়ে দেখে গা গরম কি না।
–না, শরীর খারাপ নয়। আমি বলি।
–রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছিলে?
–না।
–তবে কী?
–কি জানি! আমি বলি–মন ভালো নেই।
ভিনি হাসে-পাগল কোথাকার।
–আমার বড় একা লাগছে ভিনি।
ভিনি চমকে উঠে–কেন আমরা তো আছি।
আমি শূন্য চোখে চেয়ে থাকি। কথার অর্থ বুঝবার চেষ্টা করি। পকেট হাতড়ে খুঁজি সিগারেট আর দেশলাই।
.
গত আশ্বিনে আমি আমার চৌত্রিশের জন্মদিন পার হয়ে এলুম। আমি জানি আমি খুব দীর্ঘজীবী হব–আমার কুষ্ঠিতে সেই কথা লেখা আছে। ত্রিশের ঘরে বসে আমি তাই সামনের দীর্ঘ জীবনের দিকে চেয়ে অলস ও ধীরস্থির হয়ে আছি। বিছানায় শুয়ে হাত বাড়ালেই যেমন টেবিলের ওপর সিগারেটের প্যাকেট, দেশলাই, জলের গ্লাস কিংবা ঘড়ি ছোঁয়া যায়, মৃত্যু আমার কাছে ততটা সহজে ছোঁয়ার নয়। মাঝে-মাঝে জ্যোৎস্না রাতে আমার জানালা খুলে চুপ করে বসে থাকি। হালকা বিশুদ্ধ চাঁদের আলো আমার কোলে পড়ে থাকে। ক্রমে–ক্রমে আমার রক্তের মধ্যে ডানা নেড়ে জেগে ওঠে একটি মাছ ছোট্ট আঙুলের মতো একটি মাছ–শরীর ও চেতনা জুড়ে তার অবিরল খেলা শুরু হয়। আমার চেতনার মধ্যে জেগে ওঠে একটি বোধ, আমারই ভিতর থেকে কে যেন বড় মৃদু এবং মায়ার স্বরে ডেকে দেয়, ‘সুমন, আমার সুমন।’ অকারণে চোখের জল ভেসে যায়। আস্তে-আস্তে জানলার চৌকাঠের ওপর মাথা নামিয়ে রাখি। মায়ের হাতের মতো মৃদু বাতাস আমার মাথা থেকে পিঠ পর্যন্ত স্পর্শ করে যায়। তখন মনে পড়ে–সুমন, তোমার জীবন খুব একার হবে।
ইচ্ছে
দেশলাইয়ের কাঠির অর্ধেক ভেঙে দাঁত খুঁচিয়েছিল কখন। বিড়ি ধরাতে গিয়ে সাঁটুলাল দেখে খোলের মধ্যে সেই শিবরাত্রির সলতে আধখানা বারুদমুখো কাঠি দেমাক দেখিয়ে পড়ে আছে।
আজ চৈত্রের হাওয়া ছেড়েছে খুব। কাল বৃষ্টি গেছে ক’ফোঁটা, কিন্তু আজই তেজাল রোদ আর খড়নাড়ার মতো শুকনো হাওয়া দিচ্ছে দ্যাখো। হাওয়ার থাবায় এক ঝটকায় কাঠির মিনমিনে আগুন নিবে যাবে। যদি তাই যায় তো আরও চার পো পথ বিন–বিড়িতে হাঁটো। তারপর হাজারির দোকানের আগুনেদড়িতে বিড়ি ধরিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু অতক্ষণে বিড়ি ছাড়া হাঁটা যায়! মুখে থুথু আসবে, বুক আঁকুপাঁকু করবে, কী নেই–কী নেই মনে হবে।
সাঁটুলাল দেশলাইয়ের বাক্সটা নাড়ে। ভিতরে ঢুকাটুক শব্দ করে আধখানা কাঠি দেমাকভরে নড়ে চড়ে। কাঠিটার মতলব বুঝতে পারে না সাঁটু। শালা কি বিড়ি ধরানোর ঠিক মুখে নিবে গিয়ে তাকে জব্দ করবে?
তার জীবনে পাপের অভাব নেই। ফর্দ করতে গেলে শেষ হওয়ার নয়। বেশি কথা কি, এই দেশলাইটাই তো গত পরশু বাবুদের উঠোনে পড়ে থাকতে দেখে হাতিয়ে নেয়। ঝি উনুন ধরাতে এসে ফেলে গিয়েছিল ভুলে। পরে এসে দেশলাই খুঁজে না পেয়ে বাপান্ত করছিল। তা সে সাঁটুর উদ্দেশেই বলা, নাম ধরে না বললেও, শুনে সাঁটু ভেবেছিলনাঃ, কাল থেকে ভালো হয়ে যাব।
সাঁটু দেশলাইটা হাতে নিয়ে মাঠের মধ্যিখানে ঢিবিটার ওপর বসে থাকে। দাঁতে আটকানো বিড়ি। ধরায়নি। সাঁটু ভাবে, বাবুদের বাড়ির ঝি সরস্বতীর কি উচিত হয়েছে সাঁটুকে অমন বাপ-মা তুলে গাল দেওয়াটা? ছেলের মাথা খেতেও বলেছে। যত যাই হোক সরস্বতী তো সাঁটুরই বউ! আজ না হয় সে পয়সাওয়ালা লোকের সঙ্গে বিয়ে বসেছে। তা সুখচন্দ্রের পয়সাই বা এমনকী। আটাকল খুলে ধরাকে সরা দেখছে। তারও আগের পক্ষের বউয়ের হ্যাপা সামলাতে হয়।
সরস্বতী ভাবে সুখচন্দ্র তাকে চিরকাল মাথায় নিয়ে নাচবে। ফুঃ! লাথি দিল বলে। বেশি দিন নয়।
ছেলের মাথা খেতে বলা সরস্বতীর ঠিক হয়নি। ছেলে তো সাঁটুর একার নয়, তারও। কিন্তু রেগে গেলে সরস্বতীর আর সেসব খেয়াল থাকে না। রেগে গেলে সরস্বতী একেবারে দিগবসনা।
ঢিবির ওপর কয়েক জায়গায় ঘাস পুড়ে টাক পড়েছে। এখানে সেখানে আংরা পড়ে আছে, ছাই উড়ছে অল্পস্বল্প। ডাকাতে সাধুটা ক’দিন আগেও এখানে থানা গেড়ে ছিল।
আজকাল সাঁটুলালের খুব ইচ্ছে হয় কারও কাছে গিয়ে মনের দুঃখের কথা সব উজাড় করে বলে। তার দুঃখ ঝুড়িভরা। সাধুর খোঁজ পেয়ে একদিন সন্ধেবেলা চলেও এসেছিল সাঁটুলাল। সাধুটা নাকি ভীষণ তেজালো, শূল চিমটে কিংবা ধুনি থেকে জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে লোককে তাড়া করে। তা তেজালো সাধুই সবার পছন্দ। সাঁটুরও।
সন্ধেবেলা সাঁটু ঢিবিতে উঠে দেখল নেংটি–পরা জটাধারী ভয়ঙ্কর সাধু বসে-বসে খাচ্ছে। কাছেপিঠে কেউ নেই, কেবল বেলপুকুরের মতিলাল একধারে চোরের মতো খোলা ছাতা সমুখে ধরে বসে আছে। তামাকের কারবারে মতিলাল গতবার খুব মার খেয়েছে। সেই থেকে লটারির টিকিট কেনে, হাতে গুচ্ছের কবজ আর সাধুর খোঁজ পেলেই সেখানে গিয়ে খুঁটি গাড়ে।
সাঁটুলালকে দেখে মতিলাল হাতের ইশারায় ডেকে বলল ,–এখন কথাটথা বোলো না, বাবার ভোগ হচ্ছে। আর খুব সাবধান, বাবা কিন্তু হাতের কাছে যা পায় ছুঁড়ে মারে। আমার ছাতার আড়ালে সরে এসো বরং।