খেলুড়িরা গোল হয়ে বসে ছিল। নবদুর্গা কাছে যেতেই চারি বলল বাব্বাঃ রে বাব্বাঃ। কতক্ষণ। বসে আছি তোর জন্য। এই তোর আসার সময় হল!
ধুস আমার কিছু ভালো লাগছে না।
কেন, কী আবার হলো?
কারা যেন দেখতে আসবে কাল।
পটলী একটু কম কথা কয়। সে ভারী ভালোমানুষ। খুব ছোটখাটো, রোগা আর কালো।
ফস করে বলে, উঠল, আমি জানি।
কী জানিস রে?
গোবিন্দপুরে আমার জ্যেঠতুতো দিদির শ্বশুরবাড়ি। দিদি আজই এল সকালে। মাকে বলছিল ওখানে সমীরণ না কে একটা ছেলে আছে, তার সঙ্গেই তোর সম্বন্ধ।
সমীরণ নামটা খুব এটা খারাপ লাগল না নবদুর্গার। ঠোঁট উলটে অবশ্য বলল , বয়েই গেছে বিয়ে করতে।
পটলী বলল , দিদি বলছিল সে নাকি পাগলা মানুষ।
বলিস কী? বলে সবাই চমকে উঠল।
হিহি করে হাসল পটলী, পাগলা বলতে তেমন নয় কিন্তু। খেয়ালি।
তার মানে কী? বিড়বিড় করে নাকি?
সে আমি জানি না। দিদি বলছিল, ছেলে নাকি মন্দ নয়।
চারি বলল , কেমন দেখতে? মুশকো, কালো, ঝাঁটা গোঁফ নাকি?
তা কে জানে। অত শুনিনি।
নবদুর্গা বলল , তাই হবে। আমার কপালে কি ভালো কিছু জুটবে?
মান্তু বলল , কেন বাবা, তোর কপালটা এমন কি খারাপ। আমাদের মতো তো তোর গরিব ঘর নয়। দশ-বিশ হাজার টাকা খরচ করতে পারে জ্যাঠামশাই, আমার বাবা পারবে?
কয়েক মাস আগে লোহাগঞ্জের মস্ত এক পরিবারে মান্তুর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। দশ হাজার টাকা পণের জন্য ভেস্তে যায়।
মান্তুর মুখখানা দেখে ভারী কষ্ট হল নবদুর্গার। গরিব ঘরের হলেও মান্তু দেখতে বেশ। বড় বড় চোখ, রংটাও ফরসার দিকে, ভারী ঢলঢলে মুখ। ভালো ঘরেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল প্রায়। মান্তুর বাবা হরিপদ ধারকর্জের চেষ্টাও করেছিল কম নয়। পায়নি।
মান্তর কথাটার পরই আজকের জমায়েতটার কেমন যেন তাল কেটে গেল। কারও আর কথা আসছিল না। তাদের যা বয়স এখন, তাতে সকলেরই দিন আসছে। কার ভালো বিয়ে হবে, কার খারাপ তা যেন রথের মেলায় মোয়াওয়ালা ফটিকের ঘুরণচাকি। পঞ্চাশটা পয়সা ফেললেই ফটিক তার চাকির কাঁটা বাঁই করে ঘুরিয়ে দেবে। চাকির গায়ে নম্বর লেখা। কাঁটা যে ঘরে থামবে ততটা মোয়া। কারও ভাগ্য দশও ওঠে, কারও ভাগ্য শূন্য। বিয়েটাও হল তাই। আর সে জন্যই তাদের বুকে একটা গোপন দুরদুরুনি আছে। মাঝে-মাঝে যেন শ্বাসকষ্ট হয়।
আজ জোরদার পাঠ হচ্ছে জগা খুড়োর দাওয়ায়। দশ-বারোজন জুটেছে। খেলুড়িরা একে একে চলে যাওয়ার পর জামতলা থেকে ফেরার সময়ে দৃশ্যটা দেখতে পেল নবদুর্গা। একখানা পেতলের ঝকঝকে হ্যারিকেন জ্বেলে নিয়ে বসেছে জগা খুড়ো। যাই–যাই শীত। খুড়োর গায়ে নস্যি রঙের র্যা পার।
নবদুর্গারও একটু শীত করছিল। সে অন্তি জ্যাঠাইমার দাওয়ায় পাতলা অন্ধকারে বসে চেয়ে রইল। গোবিন্দপুর কতদূর? যাবে কি সেখানে? সমীরণ নামটা কিন্তু বেশ।
দিঘির জলে সূর্য ডুবে গেল একটু আগে। পশ্চিমের আকাশে একটা ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতো মেঘ এসে শেষ আলোটুকুও পুঁছে দিচ্ছিল। এ সময়ে নবদুর্গার কেন যে রোজ কান্না পায়! রোজ পায়।
লছমীর ডাক শোনা যাচ্ছে। একটু চমকে ওঠেনবদুর্গা। লছমী খুব কমই ডাকে। আজ ডাকছে। কেন? জাবনার গামলার মধ্যে মুখ দিচ্ছে না তো! ঘাড় ফিরিয়ে–ফিরিয়ে কাকে দেখছে যেন।
হঠাৎ নবদুর্গার বুকের ভিতরটা ধক করে উঠল। রোজ সে লছমীর সোহাগ পাওয়ার জন্য জাবনাটা নেড়ে দেয়। আজ দেয়নি। তাই কি খুঁজছে? যদি তাই হয়? ইস, আনন্দে বুকটার মধ্যে যেন একটা বাতাস বয়ে গেল।
নবদুর্গা এক ছুটে গিয়ে হাঁফাতে-হাঁফাতে বলল , আমাকে খুঁজছিস, ও লছমী? আমাকে? ও আমার সোনালক্ষ্মী, ও আমার বুকের ধন…
নবদুর্গা হাত দিল গামলার মধ্যে। আর কী আশ্চর্য ভগবান, এমনও হয় নাকি? লছমী একটা বড় শ্বাস ফেলে জাবনা খেতে লাগল মসমস করে।
নবদুর্গার চোখের জল বাঁধ মানল না। হাপুস কাঁদতে কাঁদতে বলল , তা হলে তুই আমাকে ভালোবাসিস লছমী! এত ভালোবাসিস?
কত সোহাগ বল দুজনে। এ সব কেউ বুঝবে। শুধু সে বোঝে এ সব অদ্ভুত আশ্চর্য আবিষ্কার। রাত্রিবেলা যখন পাঠ শেষ করে ঘরে বসে জগা খুড়ো খই দুধে মেখে খাচ্ছে তখন গিয়ে তার ঘরে হানা দিল নবদুর্গা। জগা খুড়ো তার মস্ত অবলম্বন।
জগা খুড়ো, একটা কথা। গোবিন্দপুর থেকে কাল আমাকে কারা দেখতে আসছে গো।
তা আসুক না।
শোনোনি?
আমাকে কি কেউ কিছু বলে? পড়ে আছি একধারে কুকুরটা বেড়ালটার মতো।
এই জগা খুড়োই না বলে নরক কা মূল অভিমান!
কী হল গো তোমার খুড়ো!
জগা খুড়ো খইয়ের বড় বাটিটা মেঝের ওপর রেখে উদাস মুখে বলল , কী মনে হয় জানিস? মনে হয় বয়সকালে সংসারধর্ম করাই ভালো ছিল। তাতে তো আপনজন হত কয়েকজন। ওই দেখ খই দুধে কেমন মিশ খেয়ে গেছে। তেমনধারা মিশ খেতে পারলুম কই তোদের সংসারের সঙ্গে?
তুমি কি কালকের ঝগড়ার কথা কইছ খুড়ো? নগেনকাকা তো মাথাগরম মানুষ, সবাই তো জানে।
জগা খুড়োর সঙ্গে কাল নগেনকাকার লেগেছিল খুব। তেমন কিছু ব্যাপার নয়। নগেনকাকা তার ছেলে মদনকে খুব মারধর করছিল কাল, ঝড়পট্টিতে গিয়ে ভিডিও দেখে রাত কাবার করে ফিরেছিল বলে। নগেনকাকার মার মানে পুলিশের মারকেও হার মানায়। মোটা বেতের লাঠি দিয়ে যখন মারে আর মদন যখন চেঁচায় তখন আশপাশে মানুষ থাকতে পারে না। জগা খুড়ো গিয়ে তখন মাঝখানে পথে পড়েছিল। নগেনকাকার তাই রাগ, তুমি কে হে বারণ করার? আমি আমার ছেলেকে শাসন করছি, তুমি বলতে আসো কেন? ভালোমানুষি দেখাতে এসোনা, ছেলেটা যদি নষ্ট হয় তো তাতে তোমার তো ক্ষতি হবে না, হবে আমারই…তোমার আর কী…এইসব। গায়ে না মাখলেও চলে।