জগা খুড়ো বলে, তুমি নাকি মন্তরতন্তর জানো।
খুব হাসে নারু, শোন কথা। মন্তরতর কোথা থেকে জানব? আমাদের কি তত ক্ষমতা আছে? জগা খুড়ো হলো মাথা–পাগলা মানুষ, কত কী বলে।
নবদুর্গার খুব ইচ্ছে করে লছমীর সঙ্গে ভাব করতে। ইচ্ছে হবে না-ই বা কেন? কী সুন্দর দেখতে লছমী! দুধসাদা রঙের ওপর কালো ছোপ। তেমনি মায়াবী দু-খানা চোখ। বলতে নেই, লছমী বেশ বড়সড় গরু, তেজও তেমনি। নবদুর্গার সঙ্গে কি তা বলে লছমীর ভাব নেই? আছে। লছমী যখন মাটির কালো গামলায় জাবনা খায় তখন তো নবদুর্গাই জাবনা নেড়ে চেড়ে দেয়। তখন গলায় হাত বোলালে লছমী ভারী আরাম পায়। কিন্তু তাদের অন্য আর পাঁচটা গরু যেমন মাটির মানুষ আর বাধ্যের মানুষ, ডাকলেই কাছে আসে, লছমী তেমনটি নয়। আর এই যে নারুদার ওপর লছমীর একটু পক্ষপাত এতেও নগদুর্গার একটু হিংসে আছে। হিংসে হবে না, বলো! এত ভালোবাসে সে লছমীকে, আর লছমী কিনা অমন!
নবদুর্গার একটু হিংসে টিংসে আছে বাপু। ওই যে তার খেলুড়ি বন্ধুরা এসে জামতলায় জড়ো হয়েছে ওদের মধ্যে যেমন তোটন আর রমলা তার খুব বন্ধু অন্যরা কি তেমন? তোটনের সঙ্গে পুষ্পর যদি বেশি ভাব দেখতে পায় নবদুর্গা তবে তার হিংসে হয়। কেন, তা কে বলবে।
তোটন অবশ্য বলে, তোর একটুতেই বড্ড গাল ফোলে।
তা ফোলে বাপু, নবদুর্গা মিথ্যে কথা বলতে পারবে না।
জগা খুড়ো ওই যে আছে তার দাওয়ায় এক কোণটিতে। নগদুর্গাদের মস্ত উঠোন। তাও একটা নয়, চারখানা। বেশির ভাগই মাটির ঘর। একতলাও আছে, দোতলাও আছে। হালে একখানা পাকা দোতলাও উঠেছে ওই ধারে। জগা খুড়ো এ-বাড়ির কেউ নয়, আছে মাত্র। তিন কুলে কেউ নেই। ঘরে বসে নানারকম কিস্তুত ওষুধ, আচার এ সব বানায় আর ধর্মের বই পড়ে। এই যে বিকেলটি হয়ে আসছে, এই সময়টায় জগা খুড়ো এসে দাওয়ায় বসবে মাদুর পেতে। সামনে একখানা জলচৌকি, কত কী পাঠ করে সুরেলা গলায়। সন্ধের পর জগা খুড়োকে ঘিরে। বাড়ি আর পাড়ার বউ–ঝি আর বুড়ো–বুড়িদের জমায়েত হয়। জগা খুড়ো একদিন তাকে বলেছিল, নরক কা মূল অভিমান। তোর অত কথায়-কথায় গলা ফোলে কেন রে? ওরকমটা ভালো নয়।
তা কী করবে নবদুর্গা? তার যে হয়! নরক কা মূল অভিমান–কথাটা মনে হলে তার একটু ভয়ও হয়। তার যে কথায় কথায় গাল ফোলে ভগবান? তবে কি নরকেই যেতে হবে তাকে? মাগো! বাজিতপুরের হাটে নরকের একখানা বড় পট দেখেছিল নবদুর্গা। পাজি মেয়েদের কী দুরবস্থা বাবা! ফুটন্ত হাঁড়িতে ফেলছে একজনাকে তো অন্যজনকে চুলের মুঠি ধরে গদা দিয়ে পেটাচ্ছে। একজনকে তো ন্যাংটো করে–মাগো!
দুধে ভরা পেতলের বালতিটা নারুদার হাত থেকে নিতে–নিতে কে জানে কেন নগদুর্গা বলে ফেলল, তুমি খুব ভালো লোক নারুদাদা।
নারু হেসে লজ্জার ভাব করে বলে, শোনো কথা। আমরা কেমন করে ভালো লোক হতে পারি বলো। আমাদের কি জ্ঞান আছে? অজ্ঞানী যে বড়।
তুমি নিশ্চয়ই ভালো লোক, নইলে কি লছমী তোমাকে অত ভালোবাসত?
এটা কোনও কথা হল নবদিদি? গরু দিয়ে কি মানুষ চেনা যায়? তোমার যেমন কথা! খেলুড়িরা সব জামতলায়। পেতলের বালতিটা ভাঁড়ারঘরে মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে নবদুর্গা বলল , খেলতে যাচ্ছি মা!
দিন–রাত খেলা আর খেলা। কীসের খেলা রে? ধিঙ্গি–ধিঙ্গি মেয়েরা বসে-বসে কেবল গুজগুজ ফুসফুস। ওটা খেলা নাকি?
কথাটা মিথ্যে নয়। আজকাল তারা একটু পেকেছে। আগে যেমন পুতুলে খেলা, এক্কা–দোক্কা, চোর-চোর, গোল্লাছুট ছিল এখন আর তেমনটি ইচ্ছে যায় না। বসে-বসে গল্প করতেই ভালো লাগে। হ্যাঁ বটে, তার মধ্যে আজকাল রসের কথাও কিছু থাকছে।
সে কাঁদো–কাঁদো হয়ে বলল , যাই না মা!
মা একবার কঠিন চোখে তার দিকে চেয়ে বলল , কাল তোমাকে দেখতে আসছে গোবিন্দপুরের লোকেরা। কথাটা মনে রেখো। শেফালীকে বলে দে কাল সকালে নাপতেবুড়ি এসে যেন তোর পা ঝামা ঘষে পরিষ্কার করে দিয়ে যায়, আর বিকেল-বিকেল এসে খোঁপা বেঁধে দিয়ে যাবে।
পাত্রপক্ষের কথা নবদুর্গা জানে। এর আগেও দুটো পক্ষ এসে দেখে গেছে। এক পক্ষ পছন্দই করেনি, আর-এক পক্ষ পছন্দ করলেও দেনা-পাওনায় মেলেনি।
বিয়ের কথা ভাবতে যে তার ইচ্ছে হয় না তা নয়। কিন্তু ওই যে একলাটি সে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, অচেনা এক মানুষ আঁচলে গেরো দিয়ে টেনে নিয়ে যাবে তাকে এ কথা ভাবলে বুকে একটা কষ্ট হয়। মা, বাবা, ভাই, বোন, খেলুড়ি বন্ধুরা, ভুলো কুকুর কিংবা টেনি বেড়াল, এই গাঁ, ওই ষষ্ঠীতলা, আর ওই যে মিষ্টি তেঁতুলের ঝিরিঝিরি ছায়া, লছমী বা রাঙা গাই, এদের সবাইকে ফেলে যেতে হবে তো। তার কাছে সবাই মানুষের মতো। এমন কি বেড়াল, কুকুর, গাছ, গাঁ সব সব সব। এদের ছেড়ে গিয়ে সে কি বাঁচবে?
মায়ের যখন মেজাজ ভালো থাকে তখন মা বলে, বাঁচবি রে বাঁচবি। মেয়ে হয়ে জন্মেছিস তো পরের ঘরের জন্যই। এ জন্যই তো মেয়ে দিয়ে বংশরক্ষা হয় না। না বাঁচে কে বল তো! এই তো আমি কেমন বেঁচে আছি দেখছিস না। সব ছেড়ে আসিনি আমি? আবার সব পেয়েছিও তো!
সাঁজবেলাতে এমনিতেই মন একটু খারাপ হয়। পাত্রপক্ষের কথা শুনে আরও একটু হল। গোবিন্দপুর কেমন গাঁ কে জানে! সেখানে হয়তো সবাই গোমড়ামুখো, সবাই রাগি। কে জানে কী।