–হুঁ।
–খিদে পায়নি?
অঞ্জলি চুপ করে থাকে। কিছু বলার নেই। তারা অপরাধীর মতো মন্দারের দিকে চেয়ে আছে। জোর করে খাওয়াবে এমন সম্পর্ক নয়।
অসহ্য। মন্দার উঠে গিয়ে বুড়োর হাত থেকে প্লেট আর কাপ নিয়ে বলে–ঠিক আছে। খাচ্ছি। বাপ বেটিতে খুব অবাক হয়! তারা একটুও আশা করেনি এটা।
বুড়ো চলে গেল। মন্দার অঞ্জলিকে বলে–এসব ফর্মালিটির দরকার ছিল না। অঞ্জলি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে–ডিভোর্স জিনিসটা বাবা বোঝেন না। সেকেলে মানুষ। ওঁর কাছে এখনও তুমি জামাই, বরাবর তাই থাকবে। ওঁদের মন থেকে এসব সংস্কার তুলে ফেলা ভারী মুশকিল।
মন্দার উত্তরে দেয় না।
অঞ্জলি নিজে থেকেই আবার বলে–বাবার আর দোষ কী? আমি নিজেও মন থেকে সম্পর্ক তুলে দিতে পারিনি। স্বামী জিনিসটা যে মেয়েদের কাছে কী!
–ওসব কথা থাক।
অঞ্জলি মাথা নেড়ে বলে–থাকবে কেন! এখন তো আর আমার ভয় নেই। এইবেলা বলতে সুবিধে। আমি হয়তো আর বেশিদিন বাঁচবও না।
–কী বলতে চাও?
সংস্কারের কথা। মেয়েলি সংস্কার। মন্ত্র, সিঁদুর, যজ্ঞ–এসব কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারি না। তুমি আমার কেউ না, তবু মনে হয়, কেবলই মনে হয়…অঞ্জলি চুপ করে থাকে। একটু কাঁদে বুঝি!
মন্দার তাড়াতাড়ি বলে–অঞ্জলি, তোমাকে আমি কী একটা কথা বলতে এসেছিলাম, কিছুতেই মনে পড়ছে না। অথচ কথাটা খুব জরুরি।
–বলো।
–বললাম তো, মনে পড়ছে না।
–একটু বসে থাকো, মনে পড়বে। যদি ঘেন্না না করে তবে খাবারটা খেয়ে নাও। চা জুড়িয়ে যাচ্ছে। খেতে-খেতে মনে পড়ে যাবে।
মন্দার অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকে। অঞ্জলি তার দিকে নিবিষ্ট চোখে চেয়ে যেন বুঝবার চেষ্টা করে।
মন্দার একটু-আধটু খুঁটে খায়, চায়ে চুমুক দেয়। মনে পড়ে না।
–তুমি কি আমার কথা মাঝে-মাঝে ভাব? অঞ্জলি আচমকা জিগ্যেস করে।
–ভাবি।
–কেন ভাববা?
–তুমি আমার ওপর বড় অন্যায় করেছিলে যে।
–সে তো ঠিকই।
–তাই ভুলতে পারি না। মানুষ ভালোবাসার কথা সহজে ভোলে; প্রতিশোধের কথাটা ভুলতে পারে না।
–আমি এত অসহায় যে আমার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার কিছু নেই তোমার! আমি তো শেষ হয়েই গেছি।
–কিন্তু আমার তো শোধ নেওয়া হয়নি!
–কী শোধ নেবে বলো!
–কী জানি ভেবেই তো পাচ্ছি না।
–হায় গো, কী কষ্ট!
–খুব কষ্ট। দুপুরে কলেজে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তখন তোমাকে নিয়ে একটা দুঃস্বপ্ন দেখি।
–কীরকম দুঃস্বপ্ন?
–ভীষণ খারাপ। বলে মন্দার চুপ করে স্বপ্নের দৃশ্যটা মনে-মনে দেখে। ডবল–ডেকারে পা দানিতে অঞ্জলি, কোলে বাচ্চা, চারিদিকে আক্রমণকারী মানুষ। কিছুতেই অঞ্জলির কাছে পৌঁছতে পারছে না মন্দার।
–বলবে না? অঞ্জলি বলে।
মন্দার শ্বাস ফেলল। তারপর আস্তে-আস্তে বলল –অঞ্জলি, আমি হয়তো শ্রাবণে বিয়ে করব। পাত্রী ঠিক হয়ে গেছে। তাতে কি তুমি দুঃখ পাবে?
–পাব। তবে এটা আশা করছিলাম বলে সয়ে নেওয়া যাবে।
–শোনো, আমি তোমার কাছে মাঝে-মাঝে আসব, এরকম বসে থাকব একটু দূরে, কথা বলব। কিছু মনে করবে না তো?
–মনে করব! কী যে বলো! তুমি আসবে ভাবতেই কী ভীষণ ভালো লাগছে!
–আসব! কী তোমাকে বলতে চাই তা যতদিন না মনে পড়ছে ততদিন আসতেই হবে।
–এসো। যখন খুশি।
–আসব। অঞ্জলি, ততদিন তুমি ভালো থেকো, সাবধানে থেকো।
অঞ্জলি চুপ করে থাকে।
–চারিদিকে বিশ্রী মানুষজন, তারা তোমাকে ঠেলবে, ধাক্কাবে, ফেলে দেবে, চারিদিকে বিপদ।
–কী বলছ?
–খুব বিপদ তোমার। এই বাচ্চাটাকে নিয়ে কি তুমি বাস থেকে নামতে পারবে! আমি যে কিছুতেই তোমার কাছে যেতে পারছিনা!
–তুমি কী বলছ?
–সেইটাই তো বুঝতে পারছি না অঞ্জলি। একটু সময় লাগবে। তোমার বাচ্চাটা কি ছেলে না মেয়ে?
–ছেলে।
অকারণ প্রশ্ন। মন্দারের জেনে কোনও লাভ নেই। সে বসে রইল। মনে পড়ছে না। কতদিনে মনে পড়বে তার কোনও ঠিক নেই।
যতদিন না পড়ে ততদিন বসে থাকা ছাড়া, অপেক্ষা করা ছাড়া, পরস্পরের মুখের দিকে চিন্তিতভাবে চেয়ে থাকা ছাড়া মানুষের আর কী করার আছে?
নবদুর্গা
গরু দুইতে নারু আসছে ওই যে। বৈষ্ণবদীঘির পার দিয়ে বাঁশতলা পেরিয়ে। ভারী সুন্দর জায়গা ওটা। মিষ্টি তেঁতুলের একটা সার আছে ওখানে। সে ভারী সুন্দর তেঁতুল, পাকলেই মিষ্টি। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। এই বিকেলের দিকে গড়ানে রোদ্দুরের আলোয় ওই তেঁতুলবনে যে আলোছায়ার চিকরিমিকরি তৈরি করে তা যেন রূপকথার মতো।
এ-বাড়ির সবাই গরু দুইতে পারে। তবু নারুকে আসতে হয় লছমীর জন্য। ভারী দুষ্ট গরু। জগা খুড়ো বলে, বাপ রে, ও হল লাথ মারুয়া গরু, ওর কাছে যেতে আছে? অথচ লছমী দুধ দেয়। এককাঁড়ি। আবার লাথি বা টুসো মারতেও কসুর করে না। কিন্তু নারুর কাছে তার মাথা হেঁট। তার কাছে কোনও জারিজুরি খাটে না। নারু খুব যত্ন করে লছমীর পিছনের পা দুটো গামছা দিয়ে বাঁধে। তারপর পেতলের বালতিতে চ্যাংচুং শব্দে দুধ দোয়ায়। লছমী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, একটুও দুষ্টুমি করে না।
আচ্ছা নারুদাদা, তোমাকে কি লছমী ভয় পায়?
নারু হাসে। বলে, না রে পাগলি, ভয় পাবে কেন? ও আমাকে ভালোবাসে।
তা তোমাকেই বাসে, আর আমাদের বাসে না কেন? আমরা তো ওকে খড় বিচালি দিই, জাবনা দিই, ভাতের ফ্যান তরকারির খোসা খাওয়াই, কত আদর করি গলকম্বলে হাত বুলিয়ে।
কোনও-কোনও গোরু ও রকম হয়।