বুড়ো খুব সাবধানে জিগ্যেস করেন–কী চাও মন্দার? ওকে কিছু বলবে?
–হুঁ।
–যাও না, নিজেই চলে যাও ভিতরে। ডাকলেই সাড়া পাবে।
সাত দিনের জন্য এ-বাড়িটা তার শ্বশুরবাড়ি ছিল, এই সুন্দর বৃদ্ধটি ছিলেন তার শ্বশুর। বাড়িটা মন্দারের চেনা। একটু সংকোচ হচ্ছিল, তবু মন্দার উঠল।
বৃদ্ধ বলে–ভিতরে বাঁ-দিকের ঘরে আছে।
মন্দার যায়।
দরজা খোলা। অঞ্জলি শুয়ে আছে বিছানায়। পাশে একটা পুঁটলির মতো বাচ্চা তুলতুল করে। সে ঘুমোচ্ছে।
মন্দার ঘরে পা দিতেই অঞ্জলি মুখ ফিরিয়ে তাকাল। চমকে উঠল কিনা কে জানে! অবাক হল খুব। উঠে বসল খুব ধীরে। কোনও প্রশ্ন করল না। কেবল বাচ্চাটাকে একটা হাত বাড়িয়ে আড়াল করার চেষ্টা করল। চোখে ভয়। মন্দার হাসে। জিগ্যেস করে কবে হল?
–আজ আট দিন।
–ভালো আছ?
–না। খুব কষ্ট গেছে।
–আমার শরীরে রক্ত ছিল না। বসে শ্বাস ফেলল অঞ্জলি–খুব কষ্ট গেছে। বিকারের মতো হয়েছিল। তুমি বোসো। ওই চেয়ার টেনে নাও। কিছু বলবে?
–বলব।
–কী?
–আমি ভীষণ অসুখী।
–হওয়ার কথাই। এখন কী করতে চাও?
–কয়েকটা ভাইটাল প্রশ্ন করব।
–করো।
–তোমার প্রেমিকটি কে?
বিস্ময়ে চোখ বড় করে অঞ্জলি বলে–প্রেমিক?
–ওই বাচ্চাটার বাবার কথা বলছি।
–সে আমার প্রেমিক হবে কেন? তাকে তো আমি ভালোবাসতাম না, সেও আমাকে বাসত।
–তাহলে এটা কী করে হল?
–হয়ে গেল। কত কিছু এমনিই হয়ে যায় যা ঠিক বুঝতেই পারা যায় না।
মন্দার একটা শ্বাস ফেলল। ভুল প্রশ্ন। এ প্রশ্ন সে করতে চায়নি। এই প্রশ্ন করতে সে আসেনি? তবে কী প্রশ্ন? কী প্রশ্ন?
সে বলল –তুমি ওর বাবাকে বিয়ে করবে না?
–বিয়ে! ভারি অবাক হয় অঞ্জলি, বলে–তা কি সম্ভব? সে কোথায় চলে গেছে! তা ছাড়া আমি তা করতে যাব কেন? ওটা বড় বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে।
এও ভুল প্রশ্ন। মন্দার বুঝতে পারে। এবং তারপর সে আবার একটা ভুল প্রশ্ন করে–তুমি কি আমার কাছে কিছু চাও?
–না। তুমি অনেক দিয়েছ।
–কী দিয়েছি?
–এই বাচ্চাটার একটা পরিচয়।
মন্দার বিস্ময়ে প্রশ্ন করে–ও কি আমার বাচ্চা হিসেবেই চালু থাকবে নাকি?
–যদি তুমি অনুমতি দাও।
মন্দার একটু ভেবে বলে–থাকুক।
অঞ্জলি খুশি হল। বলল –আমি জানতাম, তুমি আপত্তি করবে না।
আমি বিয়ে করছি অঞ্জলি।
–জানি। করাই উচিত।
তবু সঠিক প্রসঙ্গটা খুঁজে পাচ্ছে না মন্দার। এসব কথা নয়। এর চেয়ে জরুরি কী একটা বলবার আছে তার। বুঝতে পারছে না। খুঁজে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ তাই সে বেকুবের মতো বসে থাকে।
–তোমার শরীরে রক্ত নেই?
–না। কিছু খেতে পারতুম না গত কয়েকমাস। বাচ্চাটা তখন আমার শরীর শুষে খেয়েছে। ওর দোষ নেই। বাঁচতে তো ওকেও হবে। শরীরটা তাই গেছে।
–তোমার অসুখটা কেমন?
–বুঝতে পারছি না। তবে ভীষণ দুর্বল।
–তুমি শুয়ে থাকো বরং। শুয়ে-শুয়ে কথা বলো।
–তাই কী হয়! বলে বসে-বসে অঞ্জলি একটু কাঁদে, বলে শ্বশুরবাড়িতে এসেছ, তোমাকে কেউ আদরযত্ন করার নেই। দেখ তো কী কাণ্ডটা!
মন্দার চুপ করে থাকে।
অঞ্জলি তক্ষুনি নিজের ভুল সংশোধন করে বলে–অবশ্য এখন তো আর শ্বশুরবাড়ি এটা নয়, আমারই ভুল।
মন্দার একটু দুঃখ পায়। অঞ্জলির মুখটা ফোলা–ফোলা, শরীরও তাই। বোধহয় শরীরে জল এসে গেছে ওর।
মন্দার জিগ্যেস করে–তোমার বাচ্চাটা কেমন হয়েছে?
–ভালো আর কী। আমার শরীর থেকেই তো ওর শরীর। একটা খারাপ হলে আর একটা ভালো হবে কী করে?
কিন্তু কী কথা বলতে এসেছে মন্দার? মনে পড়ছে না, কিছুতেই মনে পড়ছে না। অথচ এসব সাধারণ কথা নয়; এ ছাড়া আর-একটা কী কথা যেন! মন্দার চুপ করে বসে থাকে। ভাবে। অঞ্জলি তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে সেই ভিতু ভাব। বোধহয় সবসময়ে নিজের অপরাধের কথা ভাবে ও, আর সবসময়ে ভয় পায় তার অপরাধের প্রতিফল কোনও-না-কোনও দিক থেকে আসবেই।
মন্দার জিগ্যেস করল–এ সব জানাজানির পর তোমার অবস্থা নিশ্চয়ই বেশ খারাপ?
অঞ্জলি মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলল –তা জেনে কী হবে?
মন্দার একটা শ্বাস ফেলল মাত্র।
সেই শ্বাসের শব্দে অঞ্জলি তার দিকে তাকাল, জলভরা চোখ। বলল –আমি খুব একা। আমার কেউ নেই।
–জানি।
–তুমি ভীষণ দয়ালু। তোমার তুলনা নেই। তুমি আমার ওপর রাগ করতে চাইছ, কিন্তু পারছ।
মন্দার একটু চমকায়। কথাটা সত্য। সে অঞ্জলির ওপর রাগ ঘৃণা সবই প্রকাশ করতে চায়। কিন্তু তার মনের মধ্যে কিছুতেই রাগের সেই ঝড়টা ওঠে না। উঠলে ভালো হত বোধহয়। মন্দার
আবার একটা শ্বাস ফেলে।
বাইরে থেকে অঞ্জলির বাবার গলা পাওয়া যায়–মন্দার!
মন্দার মুখ ফিরিয়ে ভারী অবাক হয়। সুন্দর বৃদ্ধটি দরজায় দাঁড়িয়ে। তাঁর এক হাতে খাবারের প্লেট, অন্য হাতে চায়ের কাপ। মন্দারের চোখে চোখ পড়তেই লাজুক মুখে বলে–বাড়িতে কাজের লোক নেই তাই…
মন্দার বিস্মিতভাবে বলে নিজেই করলেন?
–আমার অভ্যাস আছে। আঁতুড় ঘরে বসে খেতে ঘেন্না করে না তো বাবা! তুমি না হয়। বাইরের ঘরে এসো।
–আমি কিছু খাব না।
–খাবে না? বলে বুড়োমানুষ ভারী অপ্রতিভ হয়ে পড়ে। সাধাসাধি করতে বোধহয় তারা ভয় পায়। মন্দারকে তাদের ভীষণ ভয়।
যেন বা বুড়ো জানত যে মন্দার এ-বাড়ির খাবার খাবে না, তাই মাথা নীচু করে বলে–আচ্ছা, তাহলে বরং থাক।
অঞ্জলি অবাক হয়ে তার বাবার দিকে চেয়ে ছিল। মন্দারের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে–কলেজ থেকে এলে তো?