অঞ্জলিকে দেখতে ভালো, অন্যদিকে খুবই সাধারণ। বি–এ পড়তে-পড়তে বিয়ে হয়েছিল। খালি গলায় গাইতে পারত। রং চাপা, মাথায় গভীর চুল, ভীরু চাউনি ছিল। আর তেমন কিছু মনে পড়ে না। বিয়ের সাতদিন বাদে এক রাত্রিতে প্রায় উন্মাদ মন্দার জিগ্যেস করেছিল–তুমি প্রেগন্যান্ট?
অঞ্জলি ভীষণ ভয়ে আত্মরক্ষার জন্য দুটো হাত সামনে তুলে, ভীরু, খুব ভীরু চোখে চেয়ে বলেছিল–আমার বাবা এই বিয়ে জোর করে দিয়েছেন, আমি চাইনি–
–তুমি প্রেগন্যান্ট কি না বলো।
–হ্যাঁ।
–মাই গুডনেস।
অঞ্জলি তবু কাঁদেনি, কেবল ভয় পেয়েছিল। কী হবে তা অঞ্জলি বোধহয় জানত। মন্দার যখন অস্থির হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল তখন ঘরে অঞ্জলির বাক্স গোছানোর শব্দ পেয়েছিল। অর্থাৎ অঞ্জলি ধরেই নিয়েছিল চলে যেতে হবে। মানুষ বরাবর এই সরে যাওয়াটা বিশ্বাস করে।
ক্লান্ত মন্দার আবার একটি ফুটপাথের দোকান থেকে ভাঁড়ের চা খায়। গাছের তলায় কয়েকটা পাথর। তারই একটার ওপর, অন্যমনে বসে ভাঁড়টা শেষ করে। অঞ্জলির কাছে যাওয়াটা ভারী বিশ্রী হবে। ভাঁড়টা ছুঁড়ে ফেলে দেয় সে। অঞ্জলিদের বাড়িতে টেলিফোন নেই।
আবার একটা ট্যাক্সি নেয় মন্দার। এবার সে উত্তর কলকাতার একটা কলেজের ঠিকানা বলে ড্রাইভারকে। তারপর চোখ বুজে পড়ে থাকে। নন্দিনীর সঙ্গে দেখা করার কোনও মানে নেই। তবু এখন একটা কিছু বড় দরকার মন্দারের। কী যে দরকার তা ঠিক জানে না। নন্দিনীর সঙ্গে তার পূর্ব পরিচয় নেই। বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছে পারিবারিক যোগাযোগে।
নন্দিনীকে পেতে একটুও কষ্ট হল না। ক্লাস ছিল না বলে কমনরুমে আড্ডা দিচ্ছিল। বেয়ারা ডেকে দিয়ে গেল।
মন্দারকে দেখে নন্দিনী ভীষণ অবাক। লোকটা কী ভীষণ নির্জজ্জ! সামনের শ্রাবণে বিয়ে, তবু দেখ তার আগেই কেমন দেখা করতে এসেছে!
–আপনি?
–আমি মন্দার…
–জানি তো!
–একটু দরকারে এলাম, ক’টা কথা বলতে।
–কী কথা?
–আমার প্রথমা স্ত্রীর সম্পর্কে।
–সেও তো জানি।
–ওঃ।
–আর কিছু?
–না, আর কিছু নয়। ভেবেছিলাম বুঝি তোমাকে আমাদের বাসা থেকে কিছু জানানো হয়নি।
–আপনি ওটা নিয়ে ভাববেন না। আমি ভাবি না।
মন্দার নন্দিনীকে একটু দেখে। চোখা চেহারার মেয়ে। খুব বুদ্ধি আছে মনে হয়। বুদ্ধি ছাড়া অন্য কোনও জলুস নেই। রং ফরসা, লম্বাটে মুখ, ছোটো নাক। আলগা সৌন্দর্য কিছু নেই।
মন্দার বলল –কিছু মনে করলে না তো?
নন্দিনী হাসে-এই কথা বলার জন্য আসার কোনও দরকার ছিল না। আজকাল চড়া রোদ হয়।
–ট্যাক্সিতে এসেছি।
–অযথা খরচ।
–আমার খুব একা লাগছিল।
নন্দিনী একটু মাথা নীচু করে ভাবল। নন্দিনীর সঙ্গে মন্দারের মাত্র একবার দেখা হয়েছিল পাত্রী দেখতে গিয়ে। বিয়ে অবশ্য ঠিক হয়ে গেছে, তবু এতদূর মন্দার না করলেও পারত। তার লজ্জা করছিল।
নন্দিনী মুখ তুলে আস্তে বলল –আমার এখন অফ পিরিয়ড চলছে, শেষ ক্লাসটা পলিটিক্যাল সায়েন্সের–ওটা তো না করলেও চলবে।
–না করলেও চলবে কেন?
নন্দিনী একটু হেসে বলে–পলিটিক্যাল সায়েন্সে ফেল করব না।
মন্দারও একটু হাসে। বলে–তাহলে তো তোমার ছুটিই এখন?
মনে করলেই ছুটি।
কোথায় যাবে?
–আমি কী জানি। যদি কেউ নিয়ে যেতে চায়। খুবই চালু মেয়ে তার ভাবী বউ। এত চালু মন্দার ভাবেনি। ওর ভঙ্গি দেখে বোঝা যায় ও খুব কথা বলে। বেশ বুদ্ধির কথা, চটপট কথার জবাব দিতে পারে, রসিকতা করতে জানে, সাধারণ। লজ্জা সংকোচ ওর নেই। পাত্রী দেখতে গিয়ে এতটা লক্ষ করেনি মন্দার। তখন অভিভাবকদের সামনে হয়তো অন্যরকম হয়েছিল। একে সঙ্গে নিতে ইচ্ছে করছিল না মন্দারের। কথা নয়, চুপচাপ পাশে বসে থাকবে, এমন একজন সঙ্গী দরকার তার। যার মন খুব গভীর, যার স্পর্শকাতরতা খুব প্রখর। যে কথা ছাড়াই মানুষকে বুঝতে পারে।
মন্দার ঘড়িটা দেখে বলল –আমার চারটেয় একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। আজ থাক। কোনও দিন আসব।
একটু হতাশ হয় নন্দিনী। বলে–আসার তো দরকার ছিল না।
–ছিল। সে তুমি বুঝবে না।
–বুঝব না কেন?
আমি নিজেই বুঝি না।
বলে মন্দার কলেজ থেকে বেরিয়ে এল।
মাত্র গোটা চারেক টাকা পকেটে আছে। তবু মন্দার আবার ট্যাক্সি খুঁজতে লাগল। খানিকদূর হেঁটে পেয়েও গেল একটা। দক্ষিণ দিকে ট্যাক্সি চালাতে বলে আবার ঘাড় এলিয়ে চোখ বোজে সে। সঙ্গে-সঙ্গে দৃশ্যটা দেখতে পায়। সেই ডবল–ডেকারের পা–দানি, ভিড়, টালমাটাল অঞ্জলি, কোলে শিশু।
অঞ্জলিদের বাড়ির সামনে ট্যাক্সি ছেড়ে দিল মন্দার। ভাড়া দিতে গিয়ে পকেট সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে গেল। টাকা আর খুচরো যা ছিল সব দিয়েও পনেরো পয়সা কম হল। ট্যাক্সিওয়ালা হেসে সেটা ছেড়ে দিয়ে গেল।
দরজা খুললেন সেই সুন্দর চেহারার বৃদ্ধ। অঞ্জলির বাবা। খুলে ভারী অবাক হলেন।
–বাবাজীবন, তুমি?
–আমিই।
–এসো-এসো।
মন্দার ঘরে ঢোকে। অঞ্জলির মা নেই। ভাইরা বউ নিয়ে আলাদা থাকে। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িটা একটু অগোছালো।
–বসবে না? বুড়ো তাকে চেয়ার এগিয়ে দেয়।
মন্দার বসে। জিগ্যেস করে–কী খবর?
–খবর আর কী? কোনওরকম। বুড়ো গলা খাঁকারি দেয়।
–আমি অঞ্জলির খবর জানতে চাইছি।
বুড়োর ঠিক বিশ্বাস হয় না। একবার চোখ তুলেই নামিয়ে নেয়। বলে–সে ভিতরের ঘরে আছে।
মন্দার চুপ করে থাকে।