অংশু স্থির হয় এবার। পেছনের দরজাটা খুলে একজন রোগা ও পাগলাটে চেহারার লোক নেমে আসে। পরনে পায়জামা, হ্যাণ্ডলুমের খয়েরি পাঞ্জাবি। চুল বড়ো বড়ো। সামান্য দাড়ি আছে। চুল, দাড়ি কাঁচা-পাকা, কিন্তু লোকটার বয়স খুব বেশি নয়, পঁয়ত্রিশ-টয়ত্রিশ হবে। অংশুর বাঁ-পাশ থেকে কে যেন চাপাস্বরে বলে উঠল, এ রাসক্যাল। ডাউনরাইট রাসক্যাল।
লোকটার পেছনে একটা বাচ্চা নেমে এল। নীল প্যান্ট, সাদা জামা। বেশ রোগা। বছর পাঁচেকের বেশি বয়স নয়। মুখটায় কেমন ভ্যাবাচ্যাকা ভাব। চোখে ভয়।
নিস্তব্ধতা ভাঙল আচমকা। নিখুঁত একটা বিদ্যুৎগতি ছুঁচের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগল। কানে হাতচাপা দিয়ে অংশু একটা কাতর শব্দ করল, উঃ!
ছেলেটাকে কে যেন লরির ওপর তুলে দিয়েছে। রোগা, হাড্ডিসার, হতভম্ব ছেলেটা আর কোনো শব্দ বা কথা খুঁজে পাচ্ছে না। শুধু তীক্ষ্ণ পাখির স্বরে ডাকছে, মা…মা…মা…মা…
অংশু ধীরে ধীরে বসে পড়তে থাকে। দু-হাতে প্রাণপণে বন্ধ করে থাকতে চেষ্টা করে শ্রবণ। কিন্তু সব প্রতিরোধ ভেঙে সেই তীক্ষ্ণ পাখির ডাক তার ভেতরে সূচিমুখ হয়ে ঢুকে যায়। লন্ডভন্ড করে দিতে থাকে তার অভ্যন্তর। মা…মা…মা…মা…
অংশু মাথা নাড়ে। শব্দটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে সে। তবু দম আটকে আসতে থাকে। সে হাত তুলে বলতে চেষ্টা করে, ডেকো না! ওভাবে ডেকো না! আমি পারছি না…
কিন্তু কিছুই উচ্চারণ করতে পারে না অংশু। দু-হাতে কান চেপে সে অভিভূতের মতো চেয়ে থাকে। একটা শব্দের বুলেট বারবার এসে বিদ্ধ করে তাকে। ঝাঁঝরা করে দিতে থাকে।
দূরত্ব
মন্দার টেবিলের ওপর শুয়ে ছিল। থার্ড পিরিয়ড তার অফ। মাথার নীচে হাত, হাতের নীচে টেবিলের শক্ত কাঠ। বুকের ওপর ফ্যান ঘুরছে। শরীরটা ভালো নেই ক’দিন। সর্দি। ফ্যানের হাওয়াটা তার ভালো লাগছিল না। কিন্তু বন্ধ করে দিলে গরম লাগবে ঠিক। শার্টের গলার বোতামটা আটকে সে শুয়ে ছিল। ক্রমে ঘুম এসে গেল। আর ঘুম মানেই স্বপ্ন, কখনও স্বপ্নহীন ঘুম ঘুমোয় না মন্দার।
স্বপ্নের মধ্যে দেখল তার বউ অঞ্জলিকে। খুব ভিড়ের একটা ডবল–ডেকার থেকে নামবার। চেষ্টা করছে অঞ্জলি। অঞ্জলির কোলে একটা কাঁথা–জড়ানো আঁতুরের বাচ্চা। নীচের মানুষরা অঞ্জলিকে ঠেলে উঠবার চেষ্টা করছে, পিছনের মানুষরা নামবার জন্য অঞ্জলিকে ধাক্কা দিচ্ছে, চারিদিকের লোকেরা অঞ্জলিকে কনুই দিয়ে ঠেলছে, সরিয়ে দিচ্ছে, ধাক্কা মারছে, তার মুখখানা কাঁদো–কাঁদো, কোলের বাচ্চাটা ট্যাঁট্যাঁ করে কাঁদছে, কোনও দিকেই যেতে পারছে না সে। নামতেও না, উঠতেও না, বাচ্চাটা অঞ্জলির শরীর ভাসিয়ে বমি করে দিল, পায়খানা করল, পেচ্ছাপ করছে। চারিদিকে রাগি, বিরক্ত, ব্যস্ত মানুষরা চেঁচাচ্ছে, গাল দিচ্ছে, যেন বাচ্চাসুষ্ঠু অঞ্জলি জাহান্নামে যাক, না গেলে তারাই পাঠাবে। ঘুমের মধ্যেই মন্দার ভিড় ঠেলে অঞ্জলির কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছিল আকুলভাবে। কিন্তু প্রতিটি লোকই পাথর। কাউকে ঠেলে সরাতে পারছে না মন্দার। সে চেঁচিয়ে বলছিল–আমি কিন্তু নেমে পড়েছি অঞ্জলি, তোমাকেও নামতে হবে–এ। নামো, শিগগির নামো, বাস ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু সেই স্বর এত দুর্বল যে ফিসফিসের মতো শোনা গেল। ক্রুদ্ধ কন্ডাক্টর ডবল ঘণ্টি বাজিয়ে দিচ্ছে…অঞ্জলির কী যে হবে!
দুঃস্বপ্ন। চোখ খুলে মন্দার বুকের ওপর ঘুরন্ত পাখাটা দেখতে পায়। পাশ ফিরে শোয়।
অঞ্জলি এখন আর তার ঠিক বউ নয়। মাসছয়েক আগে মন্দার মামলা দায়ের করেছিল। আপসের মামলা। সেপারেশন হয়ে গেছে। অঞ্জলি যখন চলে যায় তখন তার পেটে মাসদুয়েকের বাচ্চা। এতদিনে বোধহয় বাচ্চা হয়েছে, মন্দার খবর রাখে না। দেখেনি। ছেলে না মেয়ে, তা জানতে ইচ্ছেও হয়নি। কারণ, বাচ্চাটা তার নয়।
বিয়ের সাতদিনের মধ্যে ব্যাপারটা ধরতে পারল মন্দার। তখনই মাসদুয়েকের বাচ্চা পেটে অঞ্জলির। তা ছাড়া, অঞ্জলির ব্যবহারটাও ছিল খাপছাড়া। কথার উত্তর দিতে চাইত না, ভালোবাসার সময়গুলিতে কাঁটা হয়ে থাকত। তবু দিনসাতেক ধরে অঞ্জলিকে ভালোবেসেছিল মন্দার। মেয়েদের সংস্পর্শহীন জীবনে অঞ্জলি ছিল প্রথম রহস্য। দিনসাতেকের মধ্যেই বাড়িতে অঞ্জলিকে নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়। মন্দারের কানে কথাটা তোলে তার ছোট বোন। শুনে। মন্দারের জীবনে এক স্তব্ধতা নেমে আসে। অঞ্জলি অস্বীকার করেনি। মন্দার সোজা গিয়ে যখন অঞ্জলির বাবার সঙ্গে দেখা করে তখন সেই সুন্দর চেহারার বৃদ্ধটি কেঁদে ফেলেছিলেন, আত্মপক্ষ সমর্থনে একটিও কথা বলেননি। শুধু বলেছিলেন–ওর সিঁথিতে সিঁদুরের দরকার ছিল, আমি সেটুকুর জন্য তোমাকে এই নোংরামিতে টেনে নামিয়েছি। ওকে তুমি ফেরত দেবে জানতাম। যদি একটি কথা রাখো, ওর ছোট বোনের বিয়ে আর দু-মাস বাদে, সব ঠিক হয়ে গেছে, শুধু এই ক’টা দিন কথাটা প্রকাশ কোরো না। মামলা তারপর দায়ের কোরো। আমি কথা দিচ্ছি, মামলা আমরা লড়ব না।
অঞ্জলি ফেরত গেল বিয়ের দশ দিনের মাথায়। দু-মাস অপেক্ষা করে মামলা আনে মন্দার। অঞ্জলি লড়ল না, ছেড়ে দিল। অঞ্জলির সঙ্গে আর দেখা হয়নি। বিয়ের পর আট মাস কি ন’মাস কেটে গেছে। মন্দার এখনও কেমন বেকুবের মতো স্তব্ধ হয়ে থাকে।