ক-দিন আগেই রিপ্লের বিলিভ ইট অর নট-এ সে পড়েছিল একজন লোক মোটরগাড়িতে লেভেল ক্রসিং পার হওয়ার সময় একটা ট্রেন এসে সেটার ওপর পড়ল এবং প্রায় ছশো মিটার মোটরগাড়িটাকে থ্যাঁতলাতে থ্যাঁতলাতে পিষে দলা পাকিয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলে। আশ্চর্য এই যে, মোটরচালক সামান্য কিছু কাটা-ছেঁড়া নিয়ে তা সত্ত্বেও দিব্যি বেঁচে গিয়েছিল, হাসপাতালে পর্যন্ত ভরতি হতে হয়নি। অংশুর ব্যাপারটাও তাই নয় কি?
এ বাড়িতে যে এত পাখি ডাকে তা আগে কখনো লক্ষ করেনি অংশু। আজ সঙ্গে রাণু নেই বলেই বোধ হয় করল। পাখিদের গন্ডগোলেই বোধহয় তার ঘুম এল না। শরৎকালের দিব্যি মনোরম আবহাওয়াটি ছিল আজ। ভারহীন কিছু মেঘ পায়চারি করে ফিরছে আকাশে। এবার বাদলাটা গেছে খুব। তাই চারদিকটা ধোয়া-মোছা চমৎকার। কিন্তু এমন মনোরম আবহাওয়া পেয়েও তার ঘুম এল না এক ফোঁটা। অবশ্য তাতে আশ্চর্য হওয়ার। কিছু নেই। পেটে ভাত পড়েনি, রাণু মারা গেছে, ঘুম আসার কথাও তো নয়। তবু চুপচাপ চোখ বুজে অংশু পাখিদের গন্ডগোল শুনতে লাগল।
ঘুম তো নয়ই, একে বিশ্রামও বলে না। মন প্রশান্ত না থাকলে বিশ্রাম ব্যাপারটাও একটা শক্ত ব্যায়াম মাত্র। এই বিশ্রামের ব্যায়ামটা তাকে করতে হচ্ছে একটাই মাত্র কারণে। তার প্যান্ট এখনও শুকোয়নি। না শুকোলে বেরোবে কী করে?
নিজের ফিয়াট গাড়িটার কথা শুয়ে শুয়ে ভাবল অংশু। সেকেণ্ড হ্যাণ্ড কিন্তু চমৎকার অবস্থায় ছিল কেনার সময়। তার হাতে সেট হয়ে গিয়েছিল। ইনশিয়ের করা আছে, কিছু টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়ে যাবে অংশু। তবে গাড়িটা আর ফিরবে না। পার্টসগুলো চুরি হয়ে যাবে অ্যাক্সিডেন্ট স্পট থেকে। চাকা, ব্যাটারি।
অংশু ফের উঠে হলঘরে বসে। খুবই কষ্টে। তারপর থানায় ফোন করে।
আপনারা অ্যাক্সিডেন্ট স্পট-এ কোনো পাহারা রেখেছেন?
না স্যার।
একটু পাহারা রাখলে ভালো হত না? পার্টস চুরি যাবে যে!
আমাদের লোক বড় কম।
তাহলে?
কিছু করার নেই স্যার। চুরি যাওয়ার হলে এতক্ষণে হয়ে গেছে।
হোপলেস। বলে অংশু ফোন রেখে দেয়।
ট্রাউজার এখনও শুকোয়নি। কোমরের কাছে বেশ ভেজা। তবু অংশু প্যান্ট পরে নেয়, জামা গায়ে দেয়, বিশুকে একটা রিকশা আনতে বলে বারান্দায় বসে পাখির ডাক শোনে।
রাত আটটা নাগাদ যখন বাড়ি ফিরল অংশু তখন সে অনেকটাই বিপর্যস্ত, বিভ্রান্ত, হা-ক্লান্ত। তবে বিপর্যয়ের ভাবটা সে ইচ্ছে করেই একটু বাড়িয়ে তুলেছিল। যাতে বেশি প্রশ্নের জবাব দিতে না হয়।
বাইরের ঘরেই তার জন্য অপেক্ষা করছিল সবাই। পারিবারিক ডাক্তারও তৈরি হয়েছিলেন। সে বাড়িতে পা দেওয়ামাত্র মা এসে তাকে প্রথম ধরল।
একটি প্রশ্নেরই জবাব দিতে হল তাকে।
মেয়েটা কি মারা গেছে?
হ্যাঁ।
ইশ।
ডাক্তার তাকে ঘুমের ওষুধ দিলেন। নাড়ি-টাড়ি দেখলেন একটু। তারপর ঘুমের হাতে ছেড়ে দিলেন।
অংশু ঘুমোল। প্রচন্ড গভীর টানা ঘুম। পরের দিনটাও পড়ে থাকতে হল বিছানায়। মাঝে মাঝে অফিস এবং থানা থেকে ফোন এল বাড়িতে। ভাগ্য ভালো যে, তাকে ফোন ধরতে হল না। সে অসুস্থ, শয্যাগত এবং আণ্ডার সেডেশন, সুতরাং জবাব দেওয়ার দায় নেই। বাড়ির লোকেরা সারাদিন প্রায় নিঃশব্দে রইল।
কিন্তু এই অবস্থা তো স্থায়ী হবে না। তাকে জাগতে হবে এবং মুখোমুখি হতে হবে সকলের। অনেক প্রশ্ন আছে ওদের। সংগত প্রশ্ন, বিপজ্জনক প্রশ্ন। প্রশ্ন করবে পুলিশ, প্রশ্ন করবে অফিসের সহকর্মীরা। একটু নিটোল, ছিদ্রহীন মিথ্যে গল্প বানানো খুব সহজ হবে না। কোনো মিথ্যেই তো ছিদ্রহীন নয়।
চোখ খুলতেই লজ্জা করছিল অংশুর। আলপনার মুখ শুকনো, চোখ সজল। মুখ দেখে মনে হয়, সারারাত তার পাশে বসে জেগে কাটিয়েছে। তার ছোটো ভাই অ্যাক্সিডেন্ট স্পট থেকে ঘুরে এসেছে, এটাও সে টুকরো টাকরা কথা থেকে টের পেল। থানা পুলিশ ইনশিয়য়ারেন্স সবই সে সামলাচ্ছে।
পরের রাত্রিটাও গভীর ঘুমে কেটে গেল অংশুর। জাগল বেলায়। আলপনা তার গায়ে মৃদু নাড়া দিয়ে বলল, তোমার অফিস থেকে ফোন এসেছে। জরুরি দরকার।
কে ফোন করেছে?
ডিরেক্টর নিজে। আধ ঘণ্টা পর আবার ফোন করবে।
অংশু চুপচাপ চেয়ে রইল। আস্তে আস্তে পর্দা উঠছে রঙ্গমঞ্চের। হাজার জোড়া চোখ তার দিকে চেয়ে থাকবে। সে রঙ্গমঞ্চে একা।
আধ ঘণ্টা পরই ফোনটা এল।
অংশু?
বলছি।
কেমন আছ?
একটু ভালো।
বেলা বারোটায় একবার অফিসে আসতে পারবে?
পারব।
আজ মিসেস সরকারের ডেডবডি রিলিজ করেছে সকালে। সোজা অফিসে আসছে। এখান থেকেই ক্রিমেশনে নিয়ে যাবে।
.
অফিসের সিঁড়িতে তারা নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। সামনে লরি, লরির ওপর খাটে রাণু শুয়ে আছে। অফিস থেকে বিশাল একটা টায়ারের আকৃতির মালা দেওয়া হয়েছে তার বুকের ওপর।
প্রতীকটা চমৎকার। এক লরি মেরে দিয়ে গেছে রাণুকে। আর এক লরির ওপর এখন সে শোয়া। বুকে ফুলের চাকা। চমৎকার।
এতগুলো লোকের এই সমবেত নিস্তব্ধতা ভারি অস্বস্তিকর। অংশুর অল্প অল্প ঘাম হচ্ছে। লরিটা চলে যাচ্ছে কেন? কেন চলে যাচ্ছে না?
ডিরেক্টর চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ফিলিং সিক অংশু?
একটু।
স্বাভাবিক। ইট ওয়াজ এ গ্রেট শক। মিসেস সরকারের হাজব্যাণ্ড আর বাচ্চাকে আনতে গাড়ি পাঠানো হয়েছে। দে আর বিয়িং লেট।
অংশু বুকের দুটো বোতাম খুলে ফেলল। স্টানস পালটাল পায়ের। তারপর একটা গাড়ি এসে থামল লরিটার পেছনে।