আমাদের একটা ছোট্ট পুরোনো জিনিসপত্র রাখার জন্য ঘর ছিল। সেই ঘরে ছিল সবুজ রঙের একটা তোরঙ্গ। আমি আর মিতু সেই তোরঙ্গ এক দুপুরে খুলেছিলুম। তাতে ছিল বান্ডিল–বান্ডিল পুরোনো চিঠি–সেগুলো সবই আমার বাবার লেখা মাকে, কিংবা মার লেখা বাবাকে। আমি আর মিতু হেসেছিলুম। সবজান্তা হাসি। কিন্তু মা-বাবার ওপর অকারণে আমার বড় রাগ হয়েছিল। ইচ্ছে হয়েছিল আমি ওদের আর ভালোবাসব না। মিতু বলল ,–তুই আমাকে চিঠি লিখবি? লেখ না। বানান ভুল করিস না, আর চিঠির ওপর ঠাকুর–দেবতার নাম লিখিস না। লিখবি তো? আমি বিকেলে এসে নিয়ে যাব। তারপর তোকেও দেব চিঠি।
সেই ঘটনার পর থেকে অনেক দিন আমি আমার বাবা–মার ওপর খুশি ছিলুম না। আমি বাগানে ঘুরে গাছেদের জিগ্যেস করতুম, আমি ঘরের দেওয়ালকে জিগ্যেস করতুম, রাতে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে বুকজোড়া অন্ধকারকে জিগ্যেস করতুম, কেন আমি তাদের আর ভালোবাসব মনে-মনে আমি নিজেকে ডেকে বলেছিলুম–সুমন তুই কখনও বিয়ে করিস না।
আমাদের বাড়িতে প্রায়ই জ্যোতিষেরা আসত। তাদের মধ্যে একজন একবার বাবাকে বলেছিলসুমনের বউ যেন খুব সুন্দর হয়। কখনও কুচ্ছিত কিংবা চলনসই মেয়ের সঙ্গে ওর বিয়ে দেবেন না। সইতে পারবে না।
সেই জ্যোতিষ কী বলতে চেয়েছিল তা বুঝতে পেরে আমার সমস্ত শরীর শিউরে উঠেছিল। বুঝতে পেরেছিলুম আমার ভিতরে অন্যকে ভালোবাসার ক্ষমতা কত কম! শিশুর মতো রঙিন খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে না রাখলে আমি সহজেই সব কিছুকে অবহেলা করব।
৪.
মাঘ মাসের এক গোধূলি লগ্নে ভিনির সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেল।
সমারোহ কিছুই হল না। খুব আলো জ্বলল না, বাজনা বাজল না। প্রায় স্তব্ধতার ভিতরে আমি মন্ত্রোচ্চারণ করলুম।
বাসরঘরেও আমরা ছিলুম একা। ভিনি চুপিচুপি আমাকে বলল –বাব্বাঃ, বাঁচা গেল।
কেন? আমি জিগ্যেস করলুম। ভিনি পরম নিশ্চিন্তে চোখ বুজে বলল –কী জানি ভয় হচ্ছিল শুভদৃষ্টির সময়ে হয়তো দেখব অন্য লোক। তাহলে আমি ঠিক অজ্ঞান হয়ে পিঁড়ি থেকে পড়ে যেতুম।
হাসলুম–এত ভয়।
চোখ বুজে ভিনি একটা হাত বাড়িয়ে আমার বুকে রাখল, বলল –মন, তোমার বুকের ভিতরে পালিয়ে যাওয়ার দুরদুর শব্দ। বলেই হাসল ভিনি, তেমনি চোখ বুজে থেকে বলল –সেই কবে থেকে তোমাকে ভালোবেসে আসছি মন, ভয় ছিল যদি পালিয়ে যাও! জানোনা তো তোমার জন্য মা-বাবার সঙ্গে কত ঝগড়া করলুম আমি।
আমার মাথার ভিতরে গুনগুন করে ঘুরে বেড়াতে লাগল ভিনির ওই কথাটুকু-কী জানি, ভয় হচ্ছিল শুভদৃষ্টির সময়ে হয়তো দেখব অন্য লোক।
আমি আস্তে-আস্তেভিনিকে বললুম–ভিনি একটা কথা বলি?
–হুঁ।
–ছেলেবেলায় আমার মাকে কখন ভালো লাগল জানো? যখন রান্নাবান্না আর কাজ করতে-করতে মার চুল এলোমেলো হয়ে যেত, মুখে জ্যাবজ্যাব করত ঘাম, সিঁদুর গলে নেমে আসত নাকের ওপর, যখন মার আটপৌরে শাড়িতে হলুদের দাগ, তখন মাকে আমি সবচেয়ে ভালোবাসতুম। আর মা যখন সাজগোজ করত, গায়ে পরত ফরসা জামাকাপড়, তখন মাকে বড় গম্ভীর আর রাগী দেখাত যেন ছুঁতে গেলেই বকে দেবে। কিংবা মা যখন দুঃখ পেত, চুপ করে বসে থাকত, অথবা হয়তো কোনও কারণে কাঁদত তখনই মা আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল, আমি কেবল মার আশেপাশে ঘুরঘুর করতুম। কেন বলো তো?
–কেন।
–আসলে একটু কষ্ট, একটু দুঃখের মধ্যেই মানুষকে দেখতে বোধহয় আমার ভালো লাগে।
–পাগল। বলে তিনি হাসল।
আমি একটু চুপ করে থেকে বললুম–আমার বাবাকে আমি সবচেয়ে বেশি কবে ভালোবেসেছিলুম জানো?
–কবে?
–মফসসলে রেল কলোনির এক ক্রিকেট–ম্যাচে একটি লোক ছাব্বিশ রান করে আউট হয়ে গেল। বুড়ো স্কোরারের পাশে মাঠের ঘাসে বসে আমি দেখলুম সাদা পোশাক করা লম্বা চেহারার যুবকটি ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে আসছে, মাথা অল্প নোয়ানো, হাতের ব্যাটটা শূন্যে একবার আধপাক ঘুরে গেল হতাশায়, মাথার টুপিটা খুলে নিয়ে ম্লান হাসি মুখে বাবা প্রকাণ্ড মাঠটা আস্তে আস্তে পার হয়ে প্যাভিলিয়নের তাঁবুর দিকে চলে যাচ্ছিল। সে জানত না যে সেই সময়ে মাঠের দর্শকদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশি দুঃখ পাচ্ছিল তার জন্য, সে আমি। বাবা আউট হয়ে গেল বলে না, আসলে বাবার ওই হেঁটে ফিরে আসা, আধপাক ঘুরে যাওয়া ব্যাটটার হতাশা আর মুখের হাসিটুকুর জন্য আমি কেঁদেছিলুম। তারপর থেকে বাবাকে যে আমি কি ভীষণ, ভীষণ ভালোবাসি ভিনি। এখনও যে বাবাকে ভালোবাসি তার কারণ বোধহয় ওই মুহূর্তটি, বাবার আউট হয়ে ফিরে আসার ওই মুহূর্তটি। বাবা বলে ভাবতেই ওই দৃশ্য আজও আমার চোখের সামনে স্পষ্ট ফুটে ওঠে। কেন বলো তো?
–কেন? আমি অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললুম–আসলে দু-একটিই ভালোবাসার মুহূর্ত থাকে আমাদের। না? বলেই হাসলুম–ছেলেবেলার তুমি মাত্র একবারই ভালোবেসেছিল আমায়।
শুনে ভিনি অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল –আমি জানি তুমি আমাকে তেমন ভালোবাসো না মন। তেমন মুহূর্ত তোমার কখনও আসেনি।
শুনে বড় চমকে উঠলুম। হেসে বললুম–পাগলি।
ও চুপ করে আমার চোখের দিকে চেয়ে বলল –তাকে কিছু আসে যায় না। আমি তো তোমাকে ভালোবাসি।
আমি হেসে গলা নামিয়ে বললুম–ভিনি তোমার গায়ে জন্মদাগটা কোথায়?
অবাক হয়ে ভিনি বলল –কেন?
বললুম–তোমার গায়ের ভোলা দাগটা খুঁজে পাইনি।
একটু চুপ করে থেকে ভিনি হঠাৎ লাল হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল–এঃ মাগো, বিচ্ছু কোথাকার…তোমার…তোমারটা কোথায়?