বাবা প্রশ্ন করলেন–আর?
উনি হেসে বললেন–একটু দেখে রাখবেন এ-ঘর ছেড়ে পালাতে পারে। সন্ন্যাসের দিকে খুব টান।
–আর? বাবার ভ্রূ কুঁচকে উঠল। দরজার আড়ালে মা ছিল। হঠাৎ তার হাতের চুড়ির ঝনাৎ শব্দ হয়েছিল। আমি বুঝেছিলুম, আমি সেই বয়সেই বুঝেছিলুম, লোকটা ভুল কথা বলছে না।
উনি একটু ভেবে বললেন, ওকে খুব সবুজের মধ্যে রাখবেন। ওর পোশাক যেন হয় সবুজ, ওর খাবারের মধ্যে বেশিরভাগ যেন হয় সবুজ রঙের, ওর চিন্তায় সবুজের প্রভাব যেন বেশি থাকে দেখবেন।
তার পরদিনই রং সাবান কিনে এনে মা আমার সমস্ত পোশাক সবুজ করে তুলেছিল। রাশি রাশি শাকপাতা অনিচ্ছায় খেতে হত আমাকে। লুডো খেলতে বসেছি, মা ছুটে এসে বলত–সুমন–বাবা, তুই সবুজ ঘর নে। বাড়িতে পোষা বুলবুলি ছিল, তার পাশে এল একটা টিয়াপাখি। জন্মদিনে এক বাক্স জলরং কিনে দিয়ে মা বলল –কেবল গাছপালার ছবি আঁকবি।
তবু আমার জানা ছিল যে, আমার জীবন খুব একার হবে। সবুজ রঙের ভিতরেও একটি উদাসীন মমতা আছে। আমার মা কিংবা বাবা তা ধরতে পারেনি।
৩.
আমার চোখে চোখ রেখে শান্ত একটু হেসে তিনি বলল –তারপর?
কী?
–তোমার চোখ দেখলেই মনে হয় কোথাও একটু বিপদের আভাস দেখলে তুমি হরিণের মতো ছুটে পালাবে। সুমন লক্ষ্মীসোনা, আমাকে ভয় পেও না। তোমার জন্য আমি অনেক কষ্ট করেছি।
আমি হাসলুম। কী জানি! আমি সুমন। ভালো মনের অধিকারী। তবু আমি জানি ভিনির জন্য আমাকে কেউ ভাববেই। ছেলেবেলা থেকেই তিনি এরকম কথা শুনেছে তার মা কিংবা আত্মীয়দের কাছে সুন্দর ভিনি, তোমার জন্য এনে দেব সোনার রাজপুত্তুর।
কিন্তু আমি কেবল সুমন। কেবলমাত্র সুমন। নিজের কাছে আমি নিজে বড় প্রিয়। আমি বরং পালিয়ে যাব, লুকিয়ে থাকব, পা টিপে হাঁটব, লোকালয়ে যাব না, তবু কেউ যেন কোনও কিছুর জন্য আমার অনাদর না করে, অপমান যেন না করে আমায়। বরং বলি–তোমাদের সুন্দর ভিনিকে নিয়ে যাও! আমি কিছুই চাই না। আমি আমার বড় আদরের সুমন, বড় ভালোবাসার। আমার সামনে আমার সুমনকে অনাদর করো না, বাতিল করে ফেলে দিও না। বরং নিয়ে যাও তোমাদের সুন্দর ভিনিকে।
ভিনি আমার খুব কাছে এসে বলল –সুমন মনে নেই তোমার বাবার সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে তোমাদের বাড়িতে একদিন আর এক রাত ছিলুম আমি। সন্ধেবেলা মায়ের কথা মনে পড়তে আমি খুব কেঁদেছিলুম। তুমি খেলার মাঠ থেকে ফিরে এসে আমার কান্না দেখে খুব খেপিয়েছিলে। মনে নেই? তখন তোমার দু’হাত তুলে নাচ, নকল কান্না আর মুখের কাছে মুখ এনে চোখ বড় করে তাকানো দেখে কান্না ভুলে আমি খুব হেসেছিলুম?
মনে নেই। হেসে বললুম খেপিয়েছিলুম বলে আজও আমার ওপর রাগ পুষে রাখোনি তো ভিনি?
ও চোখ বুজে সোজা হয়ে বসে রইল, তারপর বলল –আমার গা দ্যাখো।
দেখলুম গায়ে কাঁটা দিয়েছে।
ও চোখ বুজেই সামান্য হাসল, বলল –সেদিনের কথা মনে হলে আমার সমস্ত শরীর দিয়ে শিহরণ বয়ে যায়। ওরকম সুখ আমি আর কখনও পেলুম না।
শুনে একটু লজ্জা পেলুম। কখনও মানে ভিনি আজকের কথাও বলছে কি? কে জানে মনে সন্দেহ এল, আমাকে কিশোর বয়সে যতটা ভালো লেগেছিল ভিনির ততটা আজও লাগে কি না। কিংবা হয়তো আজও ভিনি সেই কৈশোরের ভালোবাসাই বহন করে চলেছে। কি জানি।
ভিনির দুই চোখ নিঃশব্দে কথা বলছিল–আমি তোমাকে ভালোবাসি সুমন। আমি তোমাকে ভালোবাসি।
ভিনি খুব সুন্দর। বড় ভালোবাসে। আমার বুকের ভিতর লাফিয়ে উঠল একটি বল। চোখে অকারণ জল আসছিল। মনে-মনে বললুম–ভিনি সত্যি? তিন সত্যি? দিব্যি? আমার গা ছুঁয়ে বলো। দ্যাখো ভিনি আমি কিছুই না। আমি কেবলমাত্র সুমন। তাও এ নাম জানে মাত্র কয়েকজন লোক। তুমি এই নাম বুকে করে রেখেছিলে এতকাল? কেন গো? তিনটি চিঠি দিয়ে তুমি ডেকেছিলে আমায় কি সত্যি? সত্যি বটে তোমার খেলামাটির রান্নাঘরে মাঝে-মাঝে আমার নিমন্ত্রণ ছিল, পাথরকুচি পাতার লুচি আর কাদামাটির তরকারি আমি জিভ আর ঠোঁটের কৌশলে চকচক শব্দ করে নকল খাওয়া খেয়েছি, সত্য বটে, তোমাকে আমি দেখিয়েছিলুম দু-হাত তুলে বাঁদরনাচ কিংবা চোখের পাতা উলটে ভয় দেখানোর খেলা। কিন্তু তারপর ক্রমে আমি তোমাকে ভুলেও গিয়েছিলুম। পনেরো–ষোলো বছর পরের এই তোমাকে আমি চিনিই না। ভিনি, মা–কালীর দিব্যি, সত্যি বলো। তিন সত্যি? আমার পা ছুঁয়ে বলো!
.
ভিনি চলে গেলে রাতে আমার ঘুম এল না। আমার শরীরের ভিতরে একটিমাত্র যন্ত্রণার মাছ একা খেলা করে ফিরছে। কখনও পেটে, কখনও বুকে, কখনও মাথায়। ঠিক কোথায় যে তা বুঝতে পারি না। ওই মাছ আমার সমস্ত শরীরে এবং চেতনায় একটিমাত্র কথাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে–সুমন, তোমার জীবন বড় একার হবে।
আমি জানি। আমি তা জানি। অন্ধকারে আমি আপনমনে মাথা নাড়লুম। তারপর চুপিচুপি আমার বালিশের কাছে বলে রাখলুম একটি নাম। ভিনি। ভিনি। ভিনি।
ছেলেবেলায় চেনা কিশোরীদের মুখগুলি আর মনে পড়ে না। কত নাম ভুলে গেছি। তবু মিতু নামে একটি মেয়ের সঙ্গে যে একটি-দুটি দুপুর আমি কাটিয়েছিলুম আমার কৈশোরে, তা মৃত্যু পর্যন্ত মনে থাকবে। আধো-অন্ধকার ছাদের সিঁড়িতে আমরা পাশাপাশি বসেছিলাম এক দুপুরে। ছাদের ওপর ঝড়ের মতো হাওয়ায় মড়মড় করে নুয়ে পড়ছে এরিয়ালের বাঁশ, কলতলায় এঁটো বাসনের ওপর কাকদের হুড়োহুড়ি, নীচের ঘরে শীতলপাটিতে শুয়ে ভাতঘুমে মা, আর তখন আমার বুক কেঁপে উঠছিল, আমরা কথা বলছিলুম না, মিতু খুব আস্তে-আস্তে আমার আরও কাছ ঘেঁষে আসছিল। অনেক কাছে চলে এল মিতু, তার মুখ আমার মুখকে ছোঁয়–ছোঁয়। আমি সরে সরে গিয়ে রেলিঙের সঙ্গে সেঁটে গেছি, আমার বুক কাঁপছে বুকের ভিতরে আমার সেই গলার স্বর –পালা সুমন, রেলিং টপকে দেওয়াল ডিঙিয়ে পালিয়ে যা, অনেক দূরে চলে যা। আমি টের পেয়েছিলুম তখন দেওয়াল কেঁপে উঠেছিল, কথা বলে উঠেছিল সিঁড়ি, মারমার শব্দে ছুটে আসছিল ছাদের বাতাস। মিতু টেরও পায়নি। মিতু বলেছিল–তোর মুখে কেমন ভাত খাওয়ার গন্ধ! রোজ খাওয়ার পর লুকিয়ে পান খাবি, কিংবা মৌরি, তারপর ফিক করে হেসে সে বলল –আমার মুখে একটা লবঙ্গ আছে, খাবি? দাঁত টিপে সে লবঙ্গর একটি কণা আমাকে দেখাল, বলল –নে, তোর দাঁত দিয়ে কেটে নে। নে না! বলে সে আমাকে টেনে নিল। সেই সময়ে, সেই নিতান্ত কৈশোরেও আমার মনে হয়েছিল আমি এক চারা গাছ, মিতু শিকড়সুদ্ধ আমাকে উপড়ে ফেলল।