–সুন্দরমতো একজন।
চমকে মুখ ঘুরিয়ে দেখি বাড়িওলার বউয়ের মুখে একটু সবজান্তা হাসি। ওঁর অনেক বয়স তবু হাসিটা সুন্দর দেখাল–মায়ের মতো হাসি।
দুটো সিঁড়িতে দু-পা রেখে দাঁড়িয়ে রইলুম।
–খুব সুন্দর। বাড়িওলার বউ বলল –কে?
বুঝতে পারছিলুম। তবু জিজ্ঞাসা করতে ভয় করছিল–ছেলে না মেয়ে।
–ভাবসাব দেখে মনে হল আবার আসবে। বাড়িওলার বউ বলল –আমাদের ঘরে বসিয়ে রেখেছিলুম অনেকক্ষণ। চা করে খাইয়ে দিয়েছি। কথাবার্তা বেশি হয়নি, ভয় নেই।
ঘরে ঢুকে আলো জ্বাললুম। অন্ধকারকে ডেকে বললুম,–ধরা পড়ে গেছ।
রাতে শুতে গিয়ে কষ্টটা টের পেলুম। বুকে পেটে কিংবা কোথায় যে একটা বিশ্রী ব্যথা ছোট্ট একটা মাছের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘুম আসছিল না। কেবল ভয় আর ভয়। কিছু একটা ঘটবে। আমি টের পাচ্ছিলুম।
আমি এইরকম।
.
খুব বড় একটা বাড়িতে অনেক অপোগণ্ড ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমার ছেলেবেলা কেটেছিল। তারা সব আমার জ্যেঠতুতো খুড়তুতো পিসতুতো ভাইবোন–অনাদরে রুক্ষ চেহারা তাদের, ঝাকড়–মাকড় চুল, গায়ে তেলচিট ময়লা, ঝগড়াটে, হিংসুটে। প্রকাণ্ড ঘরের মেঝেয় ঢালাও এজমালি বিছানায় শুতে যাওয়ার সময় তাদের জায়গা নিয়ে ঝগড়া হত। বাড়িটাকে বড় বললুম। কিন্তু হিসেবে ধরলে বাড়িটার এলাকাই ছিল বড়, বড় উঠোন ভিতরে, বাইরে বড় কচ্ছপের পিঠের মতো ঢালু একটা মাঠ। ভিতর বাড়িতে বড় উঠোন ঘিরে কয়েকখানা ঘর–যাদের নাম ছিল পুব পশ্চিম উত্তর বা দক্ষিণের ঘর। এক উত্তরের ঘর ছাড়া আর কোনও ঘরেরই পাকা ভিত ছিল না। আমাদের বাড়িটা যে লক্ষ্মীছাড়া ছিল, কিংবা আমাদের যে খুব অভাব ছিল তা নয়। বরং উলটোটাই আমাদের অনেক ছিল। শুধু আশ্রিত আত্মীয়স্বজন আর যৌথ থাকার চেষ্টায় যে ভিড় বেড়েছিল তাইতেই বাড়িটার মধ্যে সব সময়ে ছিল একটা দিশেহারা ভাব। অনেক ছেলেমেয়ে ছিলুম আমরা, যাদের কেউ-কেউ পরে অনেক বড় কিছু হয়েছে। কিন্তু অতগুলোর মধ্যে কখন কোনটার হাত-পা কাটল, কোনটা পড়ে মরল, কোনটা পুকুরে ডুবল এই চিন্তায় একটা ‘গেল গেল’ ভাব সবসময়ে আমাদের বাড়িটায় টের পাওয়া যেত। আমার দাদুর কোনও ঢিলেমি ছিল না। –তিনি সবসময়ে কৌটোর মুখ ভালো করে আটকাতেন, দরজার হুড়কো দিতেন ঠিকমতো, আর সন্ধেবেলা আমাদের গুনে–গুনে ঘরে তুলতেন। –বাবার কাছে শোওয়ার নিয়ম ছিল না, আমরা উত্তরের ঘরের মেঝেয় শুতুম একসঙ্গে, দাদু থাকতেন চৌকিতে, বিড়বিড় করে বীজমন্ত্র বলতেন দাদু-ঠাকুমার সঙ্গে, ছোটখাটো বচসা হত, আর ঘুম ভেঙে রাতে মাঝে-মাঝে শুনতুম দাদুর গুড়ুক–গুড়ুক তামাক খাওয়ার শব্দ।
আমাদের পরিবারে নাম রাখার একটা রীতি ছিল। আমার আগের ভাইদের নাম রাখা হয়েছিল অনিমেষ, হৃষীকেশ, পরমেশ, অজিতেশ, সমরেশ ইত্যাদি। সব মিলিয়ে প্রায় উনিশজনের ওরকম নাম রাখা হয়েছিল। আমার বেলায় আর নাম পাওয়া যাচ্ছিল না। শোনা যায়। অনেক ভাবনা-চিন্তার পর আমার বড়দা রায় দিয়েছিলেন মাত্র দুটি নাম বাকি আছে আর। সুটকেস আর সন্দেশ। কোনটা পছন্দ বেছে নাও। আমার ধর্মবিশ্বাসী মেজোকাকা আমার নাম দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন ধর্মেশ। সেটা বাতিল করে দাদু আমার নাম রাখলেন সুমনেশ। ভালো মনের অধিকারী। কেউ মুখে কিছু বলেনি কিন্তু অনেকেরই পছন্দ ছিল না নামটা, আমার মায়েরও না। তাই কালক্রমে আমি শুধু সুমন হয়ে উঠেছিলাম।
আমি সুমন। ভালো মনের অধিকারী।
ওই বাড়িতে খুব বেশি বড় হয়ে উঠবার আগেই আমরা বাড়ি ছেড়েছিলুম। আমার বাবা চাকরি নিয়ে চলে গেলেন বিহারে। প্রকাণ্ড বাগানঘেরা বাংলোবাড়িতে এসে আমার সেই পাঁচ সাত বছর বয়সে প্রথম হঠাৎ মনে হয়েছিল আমার জীবন খুব একার হবে, না হঠাৎ নয়। সেই বাড়িতে প্রথম সকালবেলায় আমি বাড়িটা ঘুরে ফিরে দেখতে ছুটে বেরিয়েছিলুম। একা। সামনে পপি ফুলের বাগান, তারপর ছোট মসৃণ লন, তারপর আগাছা আর রাঙচিতার বেড়া। আমি দৌড়োতে গিয়ে থমকে গেলুম–যত যাই ততই একা। কেবল একা। শিমুলগাছ থেকে হঠাৎ হুহু। করে কেঁদে উঠল একটা কোকিল। ওরকম ডাক আমি আর কোনওদিন শুনলুম না। হাজার বছরে কোকিল বোধহয় ওরকম একবার ডাকে। আমি কি অনেক কোকিলের ডাক শুনিনি। তবু আমাদের দেশের এজমালি বাড়িতে অনেক অপোগণ্ড ছেলেমেয়ের ভিড়ে কখনও আমি কোকিলের ডাক শুনেছিলুম বলে মনে পড়ে না। একা ভোরের ভেজা বাগানে দাঁড়িয়ে আমি প্রথম একটি কোকিলকে ডাকতে এবং কাঁদতে শুনলুম। সেই মুহূর্তেই একা একটি কোকিল আর তার ডাকের সঙ্গে আমার মিলমিশ হয়ে গেল। মনে হল আমার জীবন খুব একার হবে। সেই ভোরবেলাটির কথা আজও আমার খুব মনে পড়ে। ওইরকম একটি কোকিলের ডাক কিংবা আরও তুচ্ছ একটি দুটি ঘটনা থেকে আমরা আবার নতুন করে আমাদের যাত্রা শুরু করি। করি না! আমার এতদিনের বিশ্বাস ছিল–আমার জীবন খুব একার হবে।
আমি আমার বাবাকে সাদা জিনের প্যান্ট পরে ক্রিকেট টেনিস খেলতে দেখেছি। তবু বাবার ছিল সাধু–সন্ন্যাসী–জ্যোতিষ আর তুকতাকের বাতিক। খুব লম্বা সুন্দর সাদা চেহারার এক ভ ভদ্রলোক, যার পরনে গেরুয়া আলখাল্লা আর চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা, আমাকে দেখে বলেছিলেন–এ-ছেলের স্বাভাবিক ছবি আঁকার হাত আছে। এর মন একটু দার্শনিক। বলে তিনি চুপ থেকেছিলেন।