আমার স্বামীকে অন্ধকারে খুব আবছা দেখাচ্ছিল। আমি প্রাণপণে তাকিয়ে তাঁর মুখের ভাবসাব লক্ষ করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। উনি একটু বিমনা। গলায় বললেন–অনু, সত্যচরণের ওখান থেকে বেরিয়ে সেই রাত্রে প্রথম বর্ষার জলে আমি ভিজেছিলাম–তুমি খুব বকেছিলে–আর পরদিন সকাল থেকেই আমার জ্বর–মনে আছে?
আমি মাথা নাড়লাম।
–সত্যচরণ তার তিনদিন পর মারা গেছে। সেই কথাটা শেষপর্যন্ত বোধহয় তার মনে পড়েনি। কিন্তু আমি যতদিন জ্বরে পড়েছিলাম ততদিন, তারপর জ্বর থেকে উঠে এ পর্যন্ত কেবলই ভাবছি কী সেটা যা সত্যচরণ চেয়েছিল! সবাই চায়, অথচ তবু তার মনে পড়ল না কেন?
বলতে-বলতে আমার স্বামী দু-হাতে আমার মুখ নিয়ে গম্ভীরভাবে আমাকে দেখলেন। তারপর আস্তে-আস্তে বললেন–তবু সত্যচরণ যখন চেয়েছিল তখন আমার ইচ্ছে করছিল সত্যচরণ যা চাইছে সেটা ওকে দিই। যেমন করে হোক সেটা এনে দিই ওকে। কিন্তু তখন তো বুঝবার উপায় ছিল না ও কী চাইছে। কিন্তু এখন এতদিনে মনে হচ্ছে সেটা আমি জানি–
আমি ভীষণ কৌতূহলী হয়ে জিগ্যেস করলাম–কী গো সেটা?
আমার স্বামী শ্বাস ফেলে বললেন–মানুষের মধ্যে সব সময়েই একটা ইচ্ছে বরাবর চাপা থেকে যায়। সেটা হচ্ছে সর্বস্ব দিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে। কোথাও কেউ একজন বসে আছেন প্রসন্ন হাসিমুখে, তিনি আমার কিছুই চান না, তবু তাঁকে আমার সর্বস্ব দিয়ে দেওয়ার কথা। টাকা-পয়সা নয়, আমার বোধবুদ্ধি–লজ্জা–অপমান–জীবনমৃত্যু–সবকিছু। বদলে তিনি কিছুই দেবেন না, কিন্তু দিয়ে আমি তৃপ্তি পাব। রোজগার করতে-করতে, সংসার করতে-করতে মানুষ সেই দেওয়ার কথাটা ভুলে যায়। কিন্তু কখনও-কখনও সত্যচরণের মতো মরবার সময়ে মানুষ দেখে সে দিতে চায়নি, কিন্তু নিয়তি কেড়ে নিচ্ছে, তখন তার মনে পড়ে-এর চেয়ে স্বেচ্ছায় দেওয়া ভালো ছিল।
আমি সুমন
আমি জানি ভিনি আমাকে ভালোবাসে। ভালোবাসে বলেই তিনি বারবার আমার কাছে ধরা পড়ে যায়; নাকি ইচ্ছে করেই ধরা দেয় কে জানে। তার সঙ্গে প্রথম দ্যাখা সেই শিশুবয়সে। তখন ও ফ্রক পরে, লালচে আভার এক ঢল চুল আর ঠোঁটের ওপরে বাঁ-ধারে একটা আঁচিল, খুব ফরসারং
–ব্যস, আর কিছু মনে নেই।
প্রথম দিন, পনেরো–ষোলো বছর পর প্রথম দিন ভিনি আমার দিকে তাকালই না। কিংবা তাকিয়ে এক পলকেই সব দেখে এবং জেনে নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ভালোমানুষ সেজে গেল নিজের মার সামনে, কে জানে। বসল খাটের ওপর জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে আমার কাছ থেকে অনেক দূরে।
সুমন, এই হচ্ছে ভিনি। ওর মা বললেন, তাঁর চোখেমুখে অহঙ্কার ঝলমল করছিল, আরও অনেক নিঃশব্দ কথা ছিল তাঁর মুখে যা তিনি বললেন না, আমি বুঝে নিলুম–দ্যাখো তো আমার ভিনি কী সুন্দর হয়েছে। দ্যাখো ওর আঙুল, ওর চুল, ওর মুখের ছাঁদ, কথা বলে দ্যাখো কী সুন্দর মিষ্টি ওর গলার স্বর, রাজপুত্রের যুগ্যি আমার ভিনি।
এইসব কথা ভিনির মায়ের মুখে লেখা ছিল কিংবা বলা ছিল। আমি বুঝে নিলুম। সঙ্গে-সঙ্গে মনে-মনে নিজের জন্য লজ্জা হচ্ছিল আমার। আমি তেমন কিছু হলুম না কেন। ভিনির বয়স হয়েছে বিয়ের, তবু কোনওদিন ওর অভিভাবকেরা আমার কথা ভাববে না-আমি বুঝে গেলুম প্রথমদিনের প্রথম কয়েক মিনিটেই। মনে-মনে বললুম–পালা সুমন, মনে-মনে যোগী ঋষি হয়ে যা। ছেলেবেলায় তুই যে সুন্দর ছিলি একথা অনেকেই ভুলে গেছে। এখন কাঠুরের মতো চেহারা তোর, গুন্ডাদের মতো ছোট করে ছাঁটা চুল, মুখের ভাব চোর-চোর, কাঠ হয়ে বসে আছিস।
কতদিন দেখা নেই! ভিনির মা বলে কী করে আমাদের ঠিকানা পেলে?
সেটা আমার গুপ্ত কথা। তাই বললুম না, হেসে এড়িয়ে গেলুম। বুঝলুম ভিনি যে আমাকে তিনটে চিঠি লিখেছিল পরপর তার কথা ওর বাড়ির কেউ জানে না। তার প্রতিটিতেই লেখা ছিল –একবার আসবেন। আপনাকে বড় দরকার আমার। আমারও প্রশ্ন–আমার ঠিকানা ভিনি পেল কোথায়!
দরকারটা আমি বুঝতে পারছিলুম না, কেন না তিনি জানালার বাইরে মুখ ঘুরিয়ে ছিল। অথচ পনেরো–ষোলো বছর পর দেখা, তারও আগে দরকারের চিঠি দেওয়া!
চা খেয়ে আমি উঠে পড়লুম–চলি।
আবার আসবে ত? ভিনির মা বলল –আমরা আর তিন-চার মাস কলকাতায় আছি। উনি রিটায়ার করলেন, হেতমপুরে ওঁদের দেশেই আমাদের বাড়ি তৈরি হচ্ছে, দু-তিনটে ঘরের ছাদ বাকি, ছাদ হলেই আমরা চলে যাব। এর মধ্যেই এসো আবার। মা-বাবা কেমন? বলে হাসলেন–কতদিন ওঁদের দেখি না।
হ্যাঁ আসব বলেই বেরিয়ে আসছিলুম, মনে-মনে তাগাদা দিচ্ছিলুম নিজেকে–পালা সুমন, ভিতুর ডিম, আর আসিস না কখনও।
সিঁড়িতে পা যখন দিয়েছি তখনই গলার স্বর শুনলুম–আমি অহঙ্কারী নই।
একঝলক ফিরে দেখলুম–পিছনে সেই লালচে চুলের ঢল আধো আলোতেও ঝলমল করছে মুখ। পাশে ওর মা দাঁড়িয়ে। তবু সঙ্কোচ নেই, কেবল ওর মায়ের মুখে একটু শুকনো ভাব আর জোর করা হাসি।
পালালুম।
২.
এতকাল আমি শান্তিতে ছিলুম। ছোট্ট একটা ঘর আমার। ছায়াময়, একটু গলির ভিতরের নির্জনে। সারাদিন প্রায়ই কথা না বলে কাটানো যেত। লোকে আমার নাম জানে না, খুব কম লোকেই আমাকে চেনে। আমি নিজের কাছেই নিজের সুমন। ভালোবাসার, আদরের সুমন।
বাড়িওলার বউ বলল –আপনার কাছে একজন এসেছিল।
–কে? অন্যমনস্ক আমি সিঁড়ি ভাঙতে–ভাঙতে ঘাড় না ফিরিয়ে জিগ্যেস করলুম।