উনি সামান্য একটু বাঁকা হাসি হেসে বললেন–তবু দ্যাখো, পরীক্ষার কথাটা ভুলতে পারছ। এ বছর নয় তো সামনের বার। কিন্তু আমি তো বলেই দিয়েছি কোনওদিন আমি পরীক্ষা দেব না-
–দিয়ো না। কে বলেছে দিতে। আমাদের অভাব কীসের! বেশ চলে যাবে। এবার ওঠো তো–
আমার স্বামীর অভিমান একটু বেশিক্ষণ থাকে। ছেলেবেলা থেকেই উনি কোথাও তেমন আদরযত্ন পাননি। অনেকদিন আগেই মা-বাবা মারা গিয়েছিল। তারপর থেকেই মামাবাড়িতে একটু অনাদরেই বড় হয়েছেন। বি . এস . সি . পরীক্ষা দিয়েই ওঁকে সে-বাড়ি ছেড়ে মির্জাপুরের একটা মেসে আশ্রয় নিতে হয়। সেই মেসে দশ বছর থেকে চাকরি করে উনি খুব নৈরাশ্যবোধ করতে থাকেন। তখন ওঁর বয়স তিরিশ। ওঁর রুম মেট ছিলেন আমার বুড়োকাকা। তিনিই মতলব করে ওঁকে একদিন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে এলেন। তারপর মেসে ফিরে গিয়ে জিগ্যেস করলেন–আমার ভাইঝিকে কেমন দেখলে? উনি খুব লজ্জা–টজ্জা পেয়ে অবশেষে বললেন–চোখ দুটি বেশ তো! তারপরই আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। আমরা উঠলাম এসে লেক গার্ডেন্সের পাশে গরিবদের পাড়া গোবিন্দপুরে। যখন এই একা বাসায় আমরা দুজন, তখন উনি আমাকে সারাক্ষণ ব্যস্ত রাখতেন দুরন্ত অভিমানে–এই যে আমি অফিসে চলে যাই, তারপর কি তুমি আর আমার কথা ভাবো! কী করে ভাববে, আমি ত্রিশ বছরের বুড়ো, আর তুমি কুড়ির খুকি। তুমি আজ জানালায় দাঁড়াওনি…কাল রাতে আমি যে জেগেছিলাম কেউ কি টের পেয়েছিল! কী ঘুম বাব্বা!
ওঁর অভিমান দুরন্ত হলেও সেটা ভাঙা শক্ত না। একটু আদরেই সেটা ভাঙানো যায়। কিন্তু এবারকার অভিমান বা রাগ সেই অনাদরে বড় হওয়া মানুষটার ছেলেমানুষি নেই–আঁকড়ে ব্যাপার। তো নয়! এই ব্যাপারটা যেন একটু জটিল। হয়তো উনি একেবারে অমূলক কথা বলছেন না। আমি সংসারের ভালোমন্দর সঙ্গে জড়িয়েই ওঁকে দেখি। এর বাইরে যে একা মানুষটা, যার সঙ্গে অহরহ বাইরের জগতের একটা অদৃশ্য বনিবনার অভাব চলছে তার কথা তো আমি জানি না। নইলে উনি কেন লোকের ডাকে সাড়া দেন না, কেন চৌবাচ্চার জলে হাত ডুবিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকেন, তা আমি বুঝতে পারতাম।
রাত্রিবেলা আমাদের ছেলেমেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে উনি হঠাৎ চুপিচুপি আমার কাছে সরে এলেন। মুখ এবং মাথা ডুবিয়ে দিলেন আমার বুকের মধ্যে। বুঝতে পারলাম তাঁর এই ভঙ্গির মধ্যে কোনও কাম ইচ্ছা নেই। এ যেমন বাপি আমার বুকে মাথা গোঁজে অনেকটা সেরকম। আমি কথা না বলে ওঁকে দু-হাতে আগলে নিয়ে ওঁর রুক্ষ মাথা, আর অনেকদিনের আ-ছাঁটা চুলের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে গভীর আনন্দের একটা শ্বাস টেনে নিলাম। বুক ভরে গেল। উনি আস্তে-আস্তে বললেন–তোমাকে মাঝে-মাঝে আমার মায়ের মতো ভাবতে ইচ্ছে হয়। এরকম ভাবটা কি পাপ?
কী জানি! আমি এর কী উত্তর দেব? আমি বিশ্ব সংসারের রীতি-নীতি জানি না। কার সঙ্গে কীরকম সম্পর্কটা পাপ, কোনটা অন্যায় তা কী করে বুঝব! যখন ফুলশয্যার রাতে প্রথম উনি আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন, সেদিনও আমার শরীর কেঁপে উঠেছিল বটে। কিন্তু সেটা রোমাঞ্চে নয়–শিহরণেও নয়, বরং মনে হয়েছিল–বাঁচলাম! এবার নিশ্চিন্ত। এই অচেনা, রোগা কালো কিন্তু মিষ্টি চেহারার দুর্বল মানুষটির সেই প্রথম স্পর্শেই আমার ভিতরে সেই ছেলেবেলার পুতুলখেলার এক মা জেগে উঠেছিল। ছেলেমেয়েরা যেমন প্রেম করে, লুকোচুরি করে, সহজে ধরা দেয় না, আবার একে অন্যকে ছেড়ে যায় আমাদের কখনও সেরকম প্রেম হয়নি।
উনি বুকে মুখ চেপে অবরুদ্ধ গলায় বললেন তোমাকে একটা কথা বলব কাউকে বোলো না। চলো জানলার ধরে গিয়ে বসি।
উঠলাম। ছোট্ট জানলার চৌখুপিতে তাকের ওপর মুখোমুখি বসলাম দুজন। বললাম বলো।
উনি সিগারেট ধরালেন, বললেন তোমার মনে আছে, বছর দুই আগে একবার কাঠের আলমারিটা কেনার সময় সত্যচরণের কাছে গোটা পঞ্চাশেক টাকা ধার করেছিলাম?
–ওমা, মনে নেই! আমি তো কতবার তোমাকে টাকাটা শোধ দেওয়ার কথা বলেছি!
আমার স্বামী একটা শ্বাস ফেলে বললেন–হ্যাঁ, সেই ধারটার কথা নয়, সত্যচরণের কথাই বলছি তোমাকে। সেদিন মাইনে পেয়ে মনে করলাম এ-মাসে প্রিমিয়াম ডিউ–ফিউ নেই, তা ছাড়া রেডিয়োর শেষ ইনস্টলমেন্টটাও গতমাসে দেওয়া হয়ে গেছে, এ-মাসে যাই সত্যচরণের টাকাটা দিয়ে আসি। সত্যচরণ ভ ভদ্রলোক, তা ছাড়া আমার বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র ওরই কিছু পৈতৃক সম্পত্তি আছে–বড়লোক বলা যায় ওকে–সেই কারণেই বোধহয় ও কখনও টাকাটার কথা বলেনি আমাকে। কিন্তু এবার দিয়ে দিই। তা ছাড়া ওর সঙ্গে অনেককাল দেখাও নেই, খোঁজখবর নিয়ে আসি। ভেবে–টেবে বিকেলে বেরিয়ে ছ’টা নাগাদ ওর নবীন পাল লেনের বাড়িতে পৌঁছোলাম। ওর বাড়ির সামনেই একটা মস্ত গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল যার কাঁচের ওপর লাল ক্রশ আর ইংরিজিতে লেখা–ডক্টর। কিছু না ভেবে ওপরে উঠে যাচ্ছি, সিঁড়ি বেয়ে হাতে স্টেথসকোপ ভাঁজ করে নিয়ে একজন মোটাসোটা ডাক্তার মুখোমুখি নেমে এলেন। সিঁড়ির ওপরে দরজার মুখেই সত্যর বউ নীরা শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। ফরসা, সুন্দর মেয়েটা, কিন্তু তখন রুখু চুল, ময়লা শাড়ি, সিঁদুর ছাড়া কপাল আর কেমন একটা রাতজাগা ক্লান্তির ভারে বিচ্ছিরি দেখাচ্ছিল ওকে। কী হয়েছে জিগ্যেস করতেই ফুঁপিয়ে উঠল–ও মারা যাচ্ছে, অজিতবাবু। শুনে বুকের ভিতরে যেন একটা কপাট হাওয়া লেগে দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। ঘরে ঢুকে দেখি সত্যচরণ পূর্বদিকে মাথা করে শুয়ে আছে, পশ্চিমের খোলা জানালা দিয়ে সিঁদুরের মতো লাল টকটকে রোদ এসে পড়েছে ওর সাদা বিছানায়। ওর মাথার কাছে ছোট টেবিলে কাটা ফল, ওষুধের শিশি–টিশি রয়েছে, মেঝেয় খাটের নীচে বেডপ্যান–ট্যান। কিন্তু এগুলো তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু না। ঘরের মধ্যে ওর আত্মীয়স্বজনও রয়েছেন কয়েকজন। দুজন বিধবা মাথার দু-ধারে ঘোমটা টেনে বসে, একজন বয়স্কা মহিলা পায়ের দিকটায়। একজন বুড়ো মতো লোক খুব বিমর্ষ মুখে সিগারেট পাকাচ্ছেন জানালার কাছে দাঁড়িয়ে, দুজন অল্পবয়সি ছেলে নীচু স্বরে কথা বলছে। দু-একটা বাচ্চাও রয়েছে ঘরের মধ্যে। তারা কিছু টের পাচ্ছিল কি না জানি না, কিন্তু সেই ঘরে পা দিয়েই আমি এমন একটা গন্ধ পেলাম যাকে কী বলব–যাকে বলা যায় মৃত্যুর গন্ধ। তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারব না কিন্তু আমার মনে হয় মৃত্যুর একটা গন্ধ আছেই। কেউ যদি কিছু নাও বলত, তবু আমি চোখ বুজেও ওই ঘরে ঢুকে বলে দিতে পারতাম যে ওই ঘরে কেউ একজন মারা যাচ্ছে। যাকগে, আমি ওই গন্ধটা পেয়েই বুঝতে পারলাম নীরা ঠিকই বলেছে, সত্য মারা যাচ্ছে। হয়তো এখুনি মরবে না, আরও একটু সময় নেবে। কিন্তু আজকালের মধ্যেই হয়ে যাবে ব্যাপারটা। আমি ঘরে ঢুকতেই মাথার কাছ থেকে একজন বিধবা উঠে গেলেন, পায়ের কাছ থেকে সধবাটিও। কে যেন একটা টুল বিছানার পাশেই এগিয়ে দিল আমাকে বসবার জন্য। তখনও সত্যর জ্ঞান আছে। মুখটা খুব ফ্যাকাশে রক্তশূন্য আর মুখের চামড়ায় একটা খড়ি–ওঠা শুষ্ক ভাব। আমার দিকে তাকিয়ে বলল –কে? বললাম–আমি রে, আমি অজিত। বলল –ওঃ অজিত! কবে এলি? বুঝলাম একটু বিকারের মতো অবস্থা হয়ে আসছে। বললাম–এইমাত্র। তুই কেমন আছিস? বলল –এই একরকম, কেটে যাচ্ছে। আমি ঠিক ওখানে আর বসে থাকতে চাইছিলাম না। তুমি তো জানো ওষুধ–টসুধের গন্ধে আমার কীরকম গা গুলোয়! তাই এক সময়ে ওর কাছে নীচু হয়ে বললাম–তোর টাকাটা দিতে এসেছি। ও খুব অবাক হয়ে বলল কত টাকা! বললাম–পঞ্চাশ। ও ঠোঁট ওলটাল–দূর, ওতে আমার কী হবে! ওর জন্য কষ্ট করে এলি কেন? আমি কি মাত্র পঞ্চাশ টাকা চেয়েছিলাম তোর কাছে? আমি তো তার অনেক বেশি চেয়েছিলাম! আমি খুব অবাক হয়ে বললাম–তুই তো আমার কাছে চাসনি! আমি নিজে থেকেই এনেছি, অনেকদিন আগে ধার নিয়েছিলাম তোর মনে নেই? ও বেশ চমকে উঠে বলল –না, ধারের কথা নয়। কিন্তু তোর কাছে আমি কী একটা চেয়েছিলাম না? সে তো পঞ্চাশ টাকার অনেক বেশি। জিগ্যেস করলাম–কী চেয়েছিলি? ও খানিকক্ষণ সাদা ছাদের দিকে চেয়ে কী ভাবল, বলল –কী যেন ঠিক মনে পড়ছে না-ওই যেসব মানুষই যা চায়–আহা, কী যেন ব্যাপারটা। আচ্ছা দাঁড়া বাথরুম থেকে ঘুরে আসি, মনে পড়বে। বলে ও ওঠার চেষ্টা করল। সেই বিধবাদের একজন এসে পেচ্ছাপ করার পাত্রটা ওর গায়ের ঢাকার নীচে ঢুকিয়ে ঠিক করে দিল। কিছুক্ষণ–পেচ্ছাপ করার সময়টায়, ও বিকৃত মুখে ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা ভোগ করল শুয়ে-শুয়ে। তারপর আবার আস্তে-আস্তে একটু গা ছাড়া হয়ে আমার দিকে চেয়ে বলল –তোর কাছেই চেয়েছিলাম না কি কার কাছে যে–মনেই পড়ছে না। কিন্তু চেয়েছিলাম বুঝলি–কোনও ভুল নেই। খুব আবদার করে গলা জড়িয়ে ধরে গালে গাল রেখে চেয়েছিলাম, আবার ভিখিরির মতো হাত বাড়িয়ে ল্যাং–ল্যাং করেও চেয়েছিলাম, আবার চোখ পাকিয়ে ভয় দেখিয়েও চেয়েছিলাম–কিন্তু শালা মাইরি দিল না…। কৌতূহলী হয়ে জিগ্যেস করলাম–কী চেয়েছিলি! ও সঙ্গে-সঙ্গে ঘোলা চোখ ছাদের দিকে ফিরিয়ে বলল –ওই যে কী ব্যাপারটা যেন–নীরাকে জিগ্যেস কর তো, ওর মনে থাকতে পারে–আচ্ছা দাঁড়া–একশো থেকে উলটোবাগে গুনে দেখি, তাতে হয়তো মনে পড়বে। বলে ও খানিকক্ষণ গুনে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল –না, সময় নষ্ট। মনে পড়ছে না। আমি তখন আস্তে-আস্তে বললাম–তুই তো সবই পেয়েছিস! ও অবাক হয়ে বলল কী পেয়েছি–আঁকী? আমি মৃদু গলায় বললাম তোর তো সবই আছে। বাড়ি, গাড়ি, ভালো চাকরি, নীরার মতো ভালো বউ, অমন সুন্দর ফুটফুটে ছেলেটা দার্জিলিঙে কনভেন্টে পড়ছে। ব্যাঙ্কে টাকা, ইন্সিওরেন্স–তোর আবার কী চাই? ও অবশ্য ঠোঁটে একটু হাসল, হলুদ ময়লা দাঁতগুলো একটুও চিকমিক করল না, ও বলল –এসব তো আমি পেয়েইছি। কিন্তু এর বেশি আর-একটা কী যেন বুঝলি–কিন্তু সেটার তেমন কোনও অর্থ হয় না। যেমন আমার প্রায়ই ইচ্ছে করে একটা গাছের ছায়ায় বসে দেখি সারাদিন একটা নদী বয়ে যাচ্ছে। অথচ ওই চাওয়াটার কোনও মাথামুণ্ডু হয় না। ঠিক সেইরকম–কী যেন একটা–আমি ভেবেছিলাম তুই সেটাই সঙ্গে করে এনেছিস! কিন্তু না তো, তুই তো মাত্র পঞ্চাশটা টাকা–তাও মাত্র যেটুকু ধার করেছিলি–কিন্তু কী ব্যাপারটা বলত, আমার কিছুতেই মনে পড়ছে না-! অথচ খুব সোজা, জানা জিনিস সবাই চায়!