পরে যখন জিগ্যেস করলাম, বাথরুমে কী করছিলে তুমি? তখন উনি বিরসমুখে বললেন, গা টা এমন শিরশির করছিল যে জল ঢালতে ইচ্ছে করছিল না। তাই চৌবাচ্চার ধারে উঠে বসে ছিলাম।
–বসেছিলে কেন?
–ঠিক বসে ছিলাম না। জলে হাত ডুবিয়ে রেখে দেখছিলাম ঠান্ডাটা সয়ে যায় কি না।
বলে তিনি কিছুক্ষণ নীরবে ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করে এক সময়ে বললেন–আসলে আমার সময়ের জ্ঞান ছিল না। বাথরুমের ভিতরটা কেমন ঠান্ডা–ঠান্ডা, জলে অন্ধকার, আর চৌবাচ্চা ভরতি জল ছলছল করে উপচে বয়ে যাচ্ছে খিলখিল করে কেমন যেন লাগে!
ভয় পেয়ে গিয়ে আমি জিগ্যেস করলাম–কেমন?
উনি ম্লান একটু হাসলেন, বললেন–ঠিক বোঝানো যায় না। ঠিক যেন গাছের ঘন ছায়ায় বসে আছি, আর সামনে দিয়ে নদী বয়ে যাচ্ছে–
সেদিন বিকেলে অফিস থেকে ফিরে এসে তিনি বললেন–বুঝলে, ঠিক করলাম এবার বেশ লম্বা অনেকদিনের একটা ছুটি নেব।
–নিয়ে?
–কোথাও বেড়াতে যাব। অনেকদিন কোথাও যাই না। অনু, আমার মনে হচ্ছে একটা চেঞ্জের দরকার। শরীরের জন্য না, কিন্তু আমার মনটাই কেমন যেন ভেঙে যাচ্ছে। অফিসে আমি একদম কাজকর্ম করতে পারছি না। আজ বেলা তিনটে নাগাদ আমার কলিগ সিগারেট চাইতে এসে দেখে যে আমি চোখ চেয়ে বসে আছি, কিন্তু সাড়া দিচ্ছি না। সে ভাবল, আমার স্ট্রোক ফোক কিছু একটা হয়েছে, তাই ভয় পেয়ে চেঁচামেচি করে সবাইকে ডেকে আনল। কী কেলেঙ্কারি! অথচ তখন আমি জেগেই আছি।
–জেগেছিলে! তবে সাড়া দাওনি কেন?
–কী জানো! আজকাল ভীষণ অলস বোধ করি। কারও ডাকে সাড়া দিতে অনেকক্ষণ সময় লাগে। এমনকী মাঝে-মাঝে অজিত ঘোষ নামটা যে আমার তা বুঝতে অনেকক্ষণ সময় লাগে। কেউ কিছু বললে চেয়ে থাকি কিন্তু বুঝতে পারি না। ফাইলপত্র নাড়তে ইচ্ছে করে না, একটা কাগজ টেবিলের এধার থেকে ওধারে সরাতে, পিনকুশনটা কাছে টেনে আনতে গেলে মনে হয় পাহাড় ঠেলার মতো পরিশ্রম করছি। সিগারেটের ছাই কত সময়ে জামায় কাপড়ে উড়ে পড়ে–আগুন ধরার ভয়েও সেটাকে ঝেড়ে ফেলি না-
শুনে, আমার বুকের ভিতরটা হঠাৎ ধক করে উঠল। বললাম–তুমি ডাক্তার দেখাও। চলো, আজকেই আমরা মহিম ডাক্তারের কাছে যাই।
–দূর! উনি হাসলেন, বললেন–আমার সত্যিই তেমন কোনও অসুখ নেই। অনেকদিন ধরে একই জায়গায় থাকলে, একই পরিবেশে ঘোরাফেরা করলে মাথাটা একটু জমাট বেঁধে যায়। ভেবে দ্যাখো, আমরা প্রায় চার-পাঁচ বছর কোথাও যাইনি। গতবার কেবল বি জ্বর পৈতেয় ব্যান্ডেল। আর কোথাও না। চলো, কাছাকাছি কোনও সুন্দর জায়গা থেকে মাসখানেক একটু ঘুরে আসি। তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। এমন জায়গায় যাব সেখানে একটা নদী আছে, আর অনেক গাছগাছালি–
আমার স্বামী চাকরি করেন অ্যাকাউন্ট্যান্ট অফিসে। কেরানি। আর কিছুদিন বাদেই তিনি সাবর্ডিনেট অ্যাকাউন্টস সার্ভিসের পরীক্ষা দেবেন বলে ঠিক করেছেন। অঙ্কে তাঁর মাথা খুব পরিষ্কার, বন্ধুরা বলে–অজিত এক চান্সে বেরিয়ে যাবে। আমারও তাই বিশ্বাস। কিছুদিন আগেও তাঁকে পড়াশুনো নিয়ে খুব ব্যস্ত দেখতাম। দেখে খুব ভালো লাগত আমার। মনে হত, ওঁর যেমন মনের জোর তাতে শক্ত পরীক্ষাটা পেরিয়ে যাবেনই। তখন সংসারের একটু ভালো ব্যবস্থা হবে। সেই পরীক্ষাটার ওপর আমাদের সংসারের অনেক পরিকল্পনা নির্ভর করে আছে। তাই চেঞ্জের কথা শুনে আমি একটু ইতস্তত করে বললাম–এখন এক-দেড় মাস ছুটি নিলে তোমার পড়াশুনোর ক্ষতি হবে না?
উনি খুব অবাক হয়ে বললেন কীসের পড়াশুনো?
–ওই যে এস–এ-এস না কী যেন!
শুনে ওঁর মুখ খুব গম্ভীর হয়ে গেল! ভীষণ হতাশ হলেন উনি। বললেন–তুমি আমার কথা ভাব, না কি আমার চাকরি–বাকরি, উন্নতি এইসবের কথা? অনু, তোমার কাছ থেকে আমি আর একটু সিমপ্যাথি আশা করি। তুমি বুঝতে পারছ না আমি কী একটা অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে আছি!
আমি লজ্জা পেলাম, তবু মুখে বললাম–বাঃ, তোমাকে নিয়ে ভাবি বলেই তো তোমার চাকরি, পরীক্ষা, উন্নতি সব নিয়েই আমাকে ভাবতে হয়। তুমি আর তোমার সংসার এ ছাড়া আমার আর কি ভাবনা আছে বলো?
উনি ছেলেমানুষের মতো রেগে চোখ–মুখ লাল করে বললেন–আমি আর আমার সংসার কি এক?
অবাক হয়ে বললাম–এক নও?
উনি ঘনঘন মাথা নেড়ে বললেন–না। মোটেই না। সেটা বোঝো না বলেই তুমি সব সময়ে আমাকে সংসারের সঙ্গে জড়িয়ে দ্যাখো, আলাদা মানুষটাকে দ্যাখো না।
হেসে বললাম–তাই বুঝি!
উনি মুখ ফিরিয়ে বললেন–তাই। আমি যে কেরানি তা তোমার পছন্দ না, আমি অফিসার হলে তবে তোমার শান্তি। এই আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি, আমি চিরকাল, এইরকম কেরানিই থাকব, তাতে তুমি সুখ পাও আর না পাও।
–থাকো না, আমি তো কেরানিকেই ভালোবেসেছি, তাই বাসব।
কিন্তু উনি এ কথাতেও খুশি হলেন না। রাগ করে জানালার থাকের ওপর বসে বাইরের মরা বিকেলের দিকে চেয়ে রইলেন। বেড়াতে গেলেন না। দেখলাম, জ্বর আসার আগের মতো ওঁর চোখ ছলছল করছে, মাঝে-মাঝে কাঁপছে ঠোঁট, হাঁটু মুড়ে বুকের কাছে তুলে এমনভাবে বসে আছেন যে রোগা দুর্বল শরীরটা দেখে হঠাৎ মনে হয় বাচ্চা একটা রোগে–ভোগা ছেলেকে কেউ কোলে করে জানালার কাছে বসিয়ে দিয়েছে।
আচ্ছা পাগল। আমাদের ছেলের বয়স সাত, মেয়ের বয়স চার। আজকালকার ছেলেমেয়ে অল্প বয়সেই সেয়ানা। তার ওপর বাসায় রয়েছে ঠিকে ঝি, ভাড়াটে আর বাড়িওয়ালার ছেলেমেয়ে এতজনের চোখের সামনে ভরসন্ধেয় কী করে আমি ওঁর রাগ ভাঙাই। তবু পায়ের কাছটিতে মেঝেতে বসে আস্তে-আস্তে বললাম–লক্ষ্মী সোনা, রাগ করে না। ঠিক আছে, চলো কিছুদিন ঘুরে আসি। পরীক্ষা না হয় এবছর না দিলে, ও তো ফি-বছর হয়–