৪.
সিনেমা থেকে বেরিয়ে লক্ষ্মীর খুব উদাস লাগছিল। দুনিয়ায় সে কাউকে গ্রাহ্য করে না, শুধু এই উদাস ভাবটাকে করে। এই যে কিছু ভালো লাগে না উদাস লাগে, এই দুনিয়ার সঙ্গে নিজেকে ভারী আলাদা মনে হয়, এই যে সিনেমা দেখেও মন ভালো হতে চায় না এই তার রোগ। ভিতরে নাড়াচাড়া নেই, নিথর, ভ্যাভ্যাতে পান্তার মতো জল–ঢ্যাপসা একটা মন নেতিয়ে পড়ে আছে।
সিনেমা হলের বাইরে দাঁড়িয়ে উদাস চোখে চেয়ে থাকে লক্ষ্মী। কোথায় যাবে তা যেন মনে পড়তে চায় না।
লক্ষ্মী একটা রিকশা নিল। স্টেশনে এসে উদাসভাবেই নৈহাটির ট্রেনে উঠে বসল। নিজের কোনও কাজের জন্য কখনও কাউকে সে কৈফিয়ত দেয় না।
উঠোনে ঢুকতেই নেড়ি কুকুরটা ভ্যাক-ভ্যাক করে তেড়ে এসে লেজ নেড়ে কুঁইছুঁই করে গা শোঁকে। কচুপাতা একটু গলা বাড়িয়ে গায়ে একটা ঝাঁপটা দেয়।
প্রথমটা কেউ টের পায়নি। কয়েক মুহূর্ত পরেই সারা বাড়িতে একটা চাপা শোরগোল পড়ে গেল।
লক্ষই করল না লক্ষ্মী। উদাস পায়ে নিজের ঘরে গিয়ে উঠল। বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে রাস্তার ধকলটা সামলাতে বড়-বড় শ্বাস টানতে লাগল।
কতক্ষণ কেটেছে কে জানে! লক্ষ্মীর হয়তো একটু ঘুমই পেয়ে থাকবে। হঠাৎ ঘরে একটা বোমা ফাটল দড়াম করে। কানের কাছে একটা বিকট গলা বলে উঠল–উকিলের শামলার তলায় ঢুকেছি? কেন আমার হাত নেই?
বলতে-না-বলতেই চুলের গোছায় বিভীষণ এক হ্যাঁচকা টানে লক্ষ্মী খাড়া হয়ে স্তম্ভিত শরীরে দাঁড়িয়ে রইল। গালে ঠাস করে একটা চড় পড়ল দু-নম্বর বোমার মতো। মেঝেয় পড়তে–না পড়তেই নড়া ধরে কে যেন ফের দাঁড় করায়।
বিকট গলাটা বলে ওঠে–কার পরোয়া করি? কোন উকিলের ইয়েতে তেল মাখাতে যাবে এই শর্মা? এই তো আইন আমার হাতে? বলি, পেয়েছ দুর্গাপদ দাস?
বলতে-না-বলতেই আর-একটা তত জোর নয় থাপ্পড় পড়ল গালে।
লক্ষ্মীর গালে হাত। ছেলেবেলা থেকে এত বড়টি হল কেউ মারেনি তাকে। এই প্রথম। কিন্তু কী আশ্চর্য দ্যাখো! মনের ম্যাদামারা ভাবটা কেমন কেটে যাচ্ছে। টগবগ করছে রক্ত। আর তো মনে হচ্ছে না পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক নেই। নেই মানে? ভীষণভাবে সম্পর্ক আছে। ভয়ঙ্কর নিবিড় সম্পর্ক সে!
মেঝেয় বসে লক্ষ্মী কাঁদতে লাগল হাঁটুতে মুখ গুঁজে। কিন্তু সে কাঁদতে হয় বলে কাঁদা। মনে মনে কী যে আনন্দে ভেসে যাচ্ছে সে!
.
দরজার একটু তফাত থেকে উঁকি মেরে দৃশ্যটা দেখে দুর্গাপদ হাঁ। বজ্জাত মেয়ে বটে। এত নাকাল করিয়ে নিজে এসেছে।
একমাত্র সন্তান মার খাচ্ছে বলে একটু কষ্টও হল দুর্গাপদর। কিন্তু লোভীর মতো জুল জ্বলে চোখে সে দেখলও দৃশ্যটা। ঠিক এরকমই দরকার কিছু লক্ষ্মীর মায়ের। দুর্গাপদ পেরে ওঠেনি। কিন্তু বহুদিনকার সেই পাকা ফোঁড়ার যন্ত্রণার মতো ব্যথাটা আজ যেন কেটে গিয়ে টনটনানি কমে গেল অনেক।
পরিশ্রান্ত নবীন ঘরে শিকল তুলে বেরিয়ে এলে পর দুর্গাপদ গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে হাসি হাসি মুখে বলল –এই না হলে পুরুষ।
.
রাত্রিবেলা লক্ষ্মী নিজের হাতে পরিবেশন করে খাওয়াচ্ছিল বাবাকে। মার খেয়ে মুখ চোখ কিছু ফুলেছে। কিন্তু সেটা নয়, দুর্গাপদ লক্ষ করল লক্ষ্মীর চোখ দু-খানায় আর সেই পাগুলে চাউনি নেই। বেশ জমজম করছে মুখ-চোখ।
লক্ষ্মী বলল –বাবা, রাতটা থেকে যাও না কেন?
নবীনও সায় দিল–রাত হয়েছে, যাওয়ার দরকারটা কি?
দুর্গাপদ মাথা নেড়ে ম্লান মুখে বলে–ও বাবা, তোর মা–কুরুক্ষেত্র করবে তা হলে। চিনিস তো!
দুর্গাপদ জানে সকলের দ্বারা সব হয় না। নিয়তি কেন বাধ্যতে।
কথা
তোমাকে আমার অনেক কথা বলার আছে টুপু।
এ কথা প্রায়ই টুপুকে বলার জন্য যায় কুশল। বলা হয় না। কী করে হবে? টুপু যে বড্ড ব্যস্ত।
কুশল কলকাতায় এসেছে চার বছর। একটা বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং শেখানোর স্কুল থেকে সে লেদ মেশিনের কাজ শিখেছিল। তার বেশি আর কী করার ছিল তার? গাঁয়ে তার বাবা মারা গেছে, কিন্তু চাষবাসের জমি আর অল্প-অল্প কিছু জীবনবিমার টাকা পেয়েছিল। তাও ভাগীদার অনেক। বিধবা মা আছে, এক দাদা আর-এক ভাই আছে, ছোট একটা বোনও। দাদা চাষবাসও দ্যাখে, সেই থেকেই সংসার চলে। কুশল কলকাতায় এসেছিল ভাগ্যের অন্বেষণে। তেমন কিছু হয়নি তার। তবে মাথাটা পরিষ্কার বলে সে মেশিনের কাজ খুব তাড়াতাড়ি শিখে নেয়। কিন্তু কাজ পাবে কোথায়? মূলধনও নেই যে ব্যাবসা করবে। সেই ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলের মালিক সুধীর ভদ্র তখন তাকে ডেকে বলে—তোমার তো বেশ পাকা মাথা, কাজ না পেলে আমার এখানেই শেখাতে লেগে যাও বাপু, হাতখরচ পাবে, থাকার জায়গাও দেব।
এক অনিচ্ছুক মামাবাড়িতে প্রায় জোর করে থাকত কুশল। তারা তাড়াতে পারলে বাঁচে। কিন্তু কুশল বড় মিষ্টভাষী আর সৎ চরিত্রের বলে একেবারে ঘাড় ধাক্কা দিতে পারছিল না। কিন্তু কুশলের বড় লজ্জা করত। থাকার জায়গা পেয়ে সে এবার উঠে এল হ্যারিসন রোডের স্কুলের বাড়িতেই।
তো এই হচ্ছে কুশলের অবস্থা। একশো টাকার কাছাকাছি তার রোজগার। থাকার জায়গার ভাড়া লাগে না, নিজে বেঁধে খায়। কষ্টে তার চলে যায়। তবে কুশল সবসময়েই জীবনের আলোকিত দিকগুলোই দেখতে পায়। যেন জগৎ সংসারকে দুভাগ করে একটা সৌভাগ্যের আলো আর দুর্ভাগ্যের অন্ধকার পাশাপাশি রয়েছে। অন্ধকারে যারা আছে তারা আলোর দিকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে, আবার আলো থেকে অন্ধকারেও কাউকে-কাউকে চলে আসতে হয়। কুশল তাই কখনও হাল ছাড়ে না। কিছু হবে, কিছু একটা হবে। হবেই।