অক্ষয় শালটা খুলে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে হাওয়া খেতে-খেতে বলে সোজা নয়। তোমার বউ বাগড়া দিতে পারে। তারও অনেক পয়েন্ট আছে। সবচেয়ে মুশকিল হল মাসোহারা নিয়ে।
নবীন ভেঁকিয়ে উঠে বলে–মাসোহারাই যদি দেব তবে আর উকিলকে খাওয়াচ্ছি কেন?
সান্ত্বনা দিয়ে উকিল বলে–সেই নিয়েই তো ভাবছি। ওরা কী-কী পয়েন্ট দেবে। আর আমাদেরই বা কী-কী পয়েন্ট সেসব গুছিয়ে ভাবতে হচ্ছে। তোমার বউ যদি বলে যে। শ্বশুরবাড়িতে তার ওপর খুব অত্যাচার হত?
অত্যাচার আবার কী? মা খুড়ি একটু ফিচফিচ করত, তা অমন সব মা খুড়িই করে। ভারী বেয়াড়া মেয়েছেলে, কাউকে গ্রাহ্য করত না। উলটে মুখ করত, বিনা পারমিশনে সিনেমায় যেত, যেসব বাড়ির সঙ্গে আমাদের ঝগড়া সেইসব বাড়িতে গিয়ে আমাদের নিন্দে করে আসত।
–মারধর করা হয়নি তো?
–কস্মিনকালেও না। বরং ও-ই উলটে আমার হাত খিমচে দিয়েছিল। একবার কামড়েও দেয়। আমি দু-একটা সটকান মেরেছি হয়তো। তাকে মারধর বলে না।
–চরিত্রদোষ ছিল কী? থাকলে একটু সুবিধে হয়। ডিভোর্সের বদলে অ্যানালমেন্ট পেয়ে যাবে, মাসোহারা দিতে হবে না।
–ছিল কি আর না? তবে সেসব খোঁজখবর আর কে নিয়েছে! অক্ষয় উকিল উঠতে-উঠতে বলে–কোন পয়েন্ট টিকবে কোনটা টিকবে না বলা শক্ত। ভাবতে হবে। তুমি বরং কাল চারটে টাকাই দিয়ে যেও।
জ্বলন্ত চোখে নবীন চেয়ে ছিল। অক্ষয় উকিলের আসল রোজগার হল জামিন দেওয়া। সস্তা হয় বলে নবীন ধরেছে, কিন্তু এখন ভারী সন্দেহ হচ্ছে তার যে লোকটা এজলাসে দাঁড়িয়ে সব গুলিয়ে না ফেলে।
জ্যোৎস্নাটা আর তেমন ভালো বলে মনে হল না নবীনের। গলায় গানও এল না। নিজের বিবাহিত জীবনের ভুল-ভ্রান্তিগুলো মনে হয়ে খুব আপশোশ হচ্ছে। ঢ্যামনা মেয়েছেলেটাকে সে চিরকালটা প্রশ্রয় দিয়েছে। উচিত ছিল ধরে আগাপাশতলা ধোলাই দেওয়া। তাহলে হাতের সুখের একটা স্মৃতি থাকত। এখন দাঁত কিড়মিড় করে মরা ছাড়া গতি নেই। আদালতে তো বড়জোর বিয়ে ভেঙে দেবে, তার বেশি কিছু করবে না। আইনে মারধরের নিয়ম নেই, কিন্তু থাকা উচিত ছিল।
কাউকে কিছু না বলে লক্ষ্মী সটকে পড়েছিল। প্রথমে সবাই ধরে নিয়েছিল, অন্য কারও সঙ্গে ভেগেছে। পথে খবর এল, তা নয়। বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠেছে। তাতে খানিকটা স্বস্তি বোধ করেছিল নবীন। মুখটা বাঁচল। কিন্তু সেই থেকে তার লোহা-পেটানো হাত-পা নিশপিশ করে।
সকালে কারখানা যাওয়ার পথে অক্ষয় উকিলের চেম্বারে উঁকি দেয় নবীন। চেম্বারের অবস্থা শোচনীয়। ওপরে টিনের চালওলা পাকা ঘরের চুন বালি গত বর্ষার স্যাঁতস্যাঁতে ভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি, ঝুরঝুর করে সব ঝরে পড়ে যাচ্ছে। উকিলের নিজস্ব চেয়ারের গদি ফেড়ে গিয়ে ছোবড়া বেরিয়ে পড়েছে। তিন আলমারি বইতে উই লেগেছে, আলমারির গায়ে উইপোকার। আঁকাবাঁকা মেটে সুড়ঙ্গ। বই অবশ্য নকল, মক্কেলদের শ্রদ্ধা জাগানোর জন্য সাজিয়ে রাখা বেশিরভাগ বই–ই ডামি। ওপরে মলাট, ভিতরটা ফোঁপরা। মক্কেলহীন ঘরে বসে অক্ষয় উকিল গত কালের শালটা গায়ে দিয়ে নাতিকে অঙ্ক কষাচ্ছে। চারটে টাকা পেয়ে গম্ভীর মুখে বলল –এ মামলা তুমি জিতেই গেছ ধরে নাও।
নবীন নিশ্চিন্ত হল না।
৩.
শীতের বেলা তাড়াতাড়ি পড়ে আসে। ওভারটাইম খেটে বেরোতে–বেরোতে সাঁঝের আঁধার ঘনিয়ে এসেছে।
কারখানা ছাড়িয়ে বাজারের পথে পা দিতেই মোড়ের মাথায় শুকনো মুখে তার শ্বশুর দুর্গাপদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু থমকাল নবীন। কথা বলা উচিত কি না ভাবছে। লোকটা তেমন খারাপ নয়।
নবীনকে বলতে হল না, দুর্গাপদই শুকনো মুখে একটু হাসি ফোঁটাবার চেষ্টা করে এগিয়ে এল –সব ভালো তো?
নবীন বে–খেয়ালে প্রণাম করে ফেলে। বলে–মন্দ কী?
দুর্গাপদ শুকনো ঠোঁট জিভে চেটে বলে–এদিকে একটু বিষয় কাজে এসেছিলাম, ভাবলাম দেখা করে যাই।
নবীনও ভদ্রতা করে জিগ্যেস করে–ওদিকে সব ভালো?
দুর্গাপদ হতাশ মুখে বলে–ভালো আর কই? তুমি উকিলের চিঠি দিয়েছ। আমি অতশত ইংরিজি বুঝি না, তবে পড়ে মনে হল, ডিভোর্স-টিভোর্স কিছু একটা কথা আছে।
নবীন বিনীতভাবেই বলল –তাই লেখার কথা। ঠিকমতো লিখেছে কি না কে জানে? আইনের ইংরিজির অনেক ঘোরপ্যাঁচ।
দুর্গাপদ বলে–শুধু ইংরেজি কি, উকিলের মুখের কথাও ভালো বোঝা যায় না। দু-বারে কড়কড়ে পঞ্চাশটা টাকা দিলাম দুটো মুখের কথা শোনার জন্য। ডিভোর্স ঠেকানোর নাকি উপায় নেই, বলছে উকিল। আমরা তবু ঠেকাতেই চাই।
নবীন গম্ভীর হয়ে বলে আমার উকিল বলছে ডিভোর্স পাওয়া নাকি খুব শক্ত। সরকার নাকি ডিভোর্স পছন্দ করে না।
–কারো কথাই বোঝা যাচ্ছে না। ওদিকে লক্ষ্মীর মা বলছে, ডিভোর্স নাকি বে-আইনি। পুলিশ খবর পেলে জেল দেবে।
নবীন হাসল।
দুর্গাপদ করুণ চোখে চেয়ে বলল –হাসছ বাবা? লক্ষ্মীর মা যে কীভাবে আমার জীবনটা ঝাঁঝরা করে দিল তা যদি জানতে।
লোহা-পেটানো শরীরটা গরম হয়ে গেল নবীনের মেনিমুখো শ্বশুরের কথা শুনে। ঝাঁকি দিয়ে বলল –স্ট্রং হতে পারেন না? মেয়েছেলেকে দরকার হলে চুলের মুঠি ধরে কিলোতে হয়।
এ-কথায় দুর্গাপদও গরম হয়ে বলল –বেশি বলো না বাবাজীবন। তুমি নিজে পেরেছ? পারলে উকিলের শামলার তলায় গিয়ে ঢুকতে না!
এ-কথায় নবীন স্তম্ভিত হয়ে গেল।