শুনে লক্ষ্মীর কী হাসি! পা ছড়িয়ে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে এল চুলে বসেছিল। হাসির চোটে সেই চুলে মুখ বুক ঢাকা পড়ল। বলল –মাসোহারার লোভ দেখাচ্ছ? তুমি মরলে সর্বস্ব তো এমনিতেই আমি পাব।
মূর্তি দেখে দুর্গাপদ ভারী মুষড়ে পড়েছিল। লক্ষ্মীর মা বলল –পুরুষমানুষ বোকা হয় সে তো জানা কথা। কিন্তু তোমার মতো এমন হাঁদারাম আর মেনিমুখো তো জন্মেও দেখিনি। লক্ষ্মী শ্বশুরবাড়ি যাবে কেন, ওর সম্মান নেই? জামাইদের দেমাকের দিন শেষ হয়ে গেছে। তারা পায়ে ধরে নিতে এলেও যাবে না? এ-বাড়িতে বাকি জীবন বসে-বসে খাবে। মেয়ে কি ফ্যালনা?
উকিলবাবুর গাড়ি এসে থামল। তাড়াহুড়োয় দুর্গাপদ লেমনেডের দাম দিতে ভুলে গিয়ে রাস্তা পেরোতে যাচ্ছিল। পিছন থেকে ‘ও দাদা দাম দিয়ে গেলেন না’ শুনে লজ্জা পেয়ে ফিরে এসে দাম মেটাতে গেলে বুড়ো দোকানদার মোলায়েম গলায় বলল –উকিলবাবুর এখন দেরি হবে। হাত পা ধোবেন, জলটল খাবেন, পাক্কা এক ঘণ্টা, রোজ দেখছি। আপনার নাম লেখানো আছে তো?
দুর্গাপদ মাথা নেড়ে বলল –জনাআস্টেকের পর।
–তাহলে আরও দেড়ঘণ্টা ধরে নিন।
–বড় উকিল ধরে বড্ড মুশকিল হল দেখছি।
–আসানও হবে। উনি হারা মামলায় জিতিয়ে দেন। কত খুনিকে খালাস করেছেন।
দুর্গাপদ বলল –কিন্তু আমারটা কিছু হল না।
–আপনার মুশকিলটা কী?
–সে আছে অনেক ঝামেলার ব্যাপার। জামাই ডিভোর্স চাইছে।
–অ। বলে বুড়ো মুখে কুলুপ আঁটল।
দুর্গাপদ লেমনেডের দাম দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে এসে উকিলবাবুর বাইরের ঘরে আরও জনাত্রিশেক লোকের মধ্যে ঠাসাঠাসি হয়ে বসে থাকে। আড়াই ঘণ্টা বসতে হবে। ঘরটা বিড়ি আর সিগারেটের ধোঁয়ায়–ধোঁয়াক্কার। শোনা গেল, উকিলবাবু এখনও চেম্বারে আসেননি। জল খাচ্ছেন বোধহয়। গুটিগুটি আরও মক্কেল আসছে।
ঝাড়া তিন ঘণ্টা। হাঁটু ব্যথা হল, মাজা ধরে গেল, হাই উঠতে লাগল ঘনঘন। তারপর ডাক এল। ব্যস্ত বড় উকিলবাবু মক্কেলদের এক-দুইবার দেখে মনে রাখতে পারেন না, তাই ফের পুরোনো পরিচয় এবং বখেরার কথা বুঝিয়ে বলতে হল। সব বুঝে উকিলবাবু হাসি-হাসি মুখ করে বললেন–ভাঙন রুখতে চাইছেন তো? কিন্তু কী দিয়ে রুখবেন? আজ হোক কাল হোক এ ভাঙবেই। আমরা ভাবের কথা বুঝি না, কেবল আইন বুঝি। কে কাকে ভালোবাসে বা বাসে না, তার বিয়ে ভাঙা ভালো নয় বা কার ভালো এসব হল নীতির কথা, ভাবের কথা। আইন তার তোয়াক্কা করে না। বলেন তো লড়তে পারি। কিন্তু খামোকা।
ফের পঁচিশটা টাকা গুণে দিয়ে দুর্গাপদ উঠে পড়ল।
২.
খেয়ে উঠে নবীন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘটির জলে আঁচাচ্ছিল। এমন সময় দেখল, উঠোনে জ্যোৎস্না পড়েছে। এই হেমন্তকালের জ্যোৎস্নার রকম–সকমই আলাদা। একটু দুধের সরের মতো কুয়াশায় মাখামাখি চাঁদখানা ভারী আহ্লাদী চেহারা নিয়ে হাসছে। বাতাসে চোরা শীত। উঠোনে বসে থাকা ঘেয়ো কুকুরটা এঁটো খেতে-খেতে ভ্যাক-ভ্যাক করে ডেকে উঠল।
নবীন কাঁধের গামছায় মুখ মুছতে-মুছতে শুনল মা তাকে ডেকে বলছে–ও নবীন, গায়ে একটা গেঞ্জি দে। এ সময়কার ঠান্ডা ভালো না।
আঁচাতে গিয়ে চারদিককার দৃশ্য দেখে জগৎ সংসার বেবাক ভুলে চেয়ে রইল নবীনচন্দ্র। ঘটিতে আঙুলের টোকা মেরে মৃদুস্বরে একটু গানও গেয়ে ফেলল সেনা মারো না মারো পিচকারি…
ঘেরা উঠোনের যে–ধারটায় দেওয়ালের গায়ে দরজাটা রয়েছে তার পাশেই মায়ের আদরের দু-দুটো মানকচুর ঝোঁপ আশকারা পেয়ে মানুষপ্রমাণ প্রকাণ্ড হয়ে উঠেছে। এক-একখানা পাতা ডবল সাইজের কুলোকেও হার মানায়। কুকুরটা ভ্যাক-ভ্যাক করে সেদিকেই বারবার ছুটে গিয়ে ফের লেজ নামিয়ে চলে আসছে। নবীনের মুখের দিকে চেয়ে কী যেন বোঝারও চেষ্টা করল ভ্যাক-ভ্যাক করে।
নবীন গান থামিয়ে বলে–কে?
কচুপাতার আড়ালে কপাটের গায়ে লেগে থাকা ছায়ামূর্তি বলে উঠল–আমি হে নবীন। কথা ছিল। আঁচাচ্ছিলে বলে ডাকিনি, বিষম খেতে পারো তো।
অক্ষয় উকিলের হয়ে এসেছে। আজকাল বড় আলতুফালতু কথা বলে। মানে হয় না।
নবীন উঠোন পেরিয়ে বাইরের ঘরে গিয়ে বাতি জ্বেলে বলে–আসুন।
বিবর্ণ একটা শাল জড়ানো বুড়োটে লোকটা খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চেয়ারে বসে ঠ্যাং তুলে ফেলল। বলল –ডিভোর্সের মামলা বড় সোজা নয় হে।
নবীন ভ্রূ কুঁচকে বলল –ও-পক্ষ কোনও জবাব দিয়েছে?
–জবাব এত টপ করে দেবে? অত সোজা নাকি? যা সব আমেন্ট দিয়েছি তার জবাব ভেবে বের করে মুসাবিদা করতে পুঁদে উকিলের কালঘাম ছুটে যাবে। তবে এও ঠিক কথা ডিভোর্স জিনিসটা অত সহজ নয়।
নবীন গম্ভীর মুখে বলে–শক্তটাই বা কী? রোজ কাঁড়ি–কাঁড়ি ডিভোর্স হচ্ছে দেখছি।
–আরে না। সরকার ডিভোর্স জিনিসটা পছন্দ করে না। আইনের অনেক ফ্যাঁকড়া আছে। যা হোক সে নিয়ে আমি ভাবব, তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। খরচাপাতি কিছু দেবে না কি আজ?
–খরচা আবার কী? নবীন অবাক হয়ে বলে–এখনও মোকদ্দমা শুরুই হয়নি।
–আছে, আছে। মোকদ্দমা শুরু হয়নি বলে কি আর উকিলের বসে থাকলে চলে? আইনের পাহাড় প্রমাণ বই ঘাঁটতে হচ্ছে না? এই যে মাঝে-মাঝে এসে খবর দিচ্ছি এর জন্যও তো কিছু পাওনা হয় বাপু। মহেশ উকিলের সঙ্গে বাজারদর নিয়ে কথা বলতে গেলে পর্যন্ত ফিজ চায়।
নবীন বেজার হল। তবে বলল ঠিক আছে, কাল সকালে কারখানায় যাওয়ার সময় দুটো টাকা দিয়ে আসব’খন। মোকদ্দমাটা বুঝছেন কেমন?