কতকগুলো ব্যাপার আছে যা কেবল উকিল ডাক্তার বা অফিসাররাই জানে, আর কেউ জানে। মুশকিলটা সেখানেই। তার ওপর দুর্গাপদ কস্মিনকালে মামলা মোকদ্দমা বা কোর্টকাছারি করেনি। উকিলবাবু আগের দিনই সাফ বলে দিয়েছে–কেউ বিয়ে ভাঙতে চাইলে আটকানো কি যায়? কিছুদিন ঝুলিয়ে রাখতে পারি বড় জোর। আর চাও তো, বেশ ভালো মাসোহারার ব্যবস্থাও করে দিতে পারি। সে এমন ব্যবস্থা যাতে বাছাধনকে দ্বিতীয়বার বিয়ে বসতে খুব ভেবেচিন্তে বসতে হবে।
কিন্তু দুর্গাপদ তার জামাইকে খুব একটা অপছন্দ করে না। লোকটা নরম সরম ভদ্র, বিনয়ী, খরচে ধরনের। বরং তার মেয়ে লক্ষ্মীই ট্যাটন। বিয়ের আগে পাড়া জ্বালিয়েছে। বিয়ের পর বছর দুই যেতে-না-যেতে বাপের বাড়িতে এসে খাদিমা হয়ে বসেছে। জামাই নিতে আসেনি। জামাইয়ের বদলে দিনকুড়ি আগে জামাইয়ের পক্ষের এক উকিলের চিঠি এসেছে। জামাই ডিভোর্সের মামলা আনছে।
তার মেয়ে লক্ষ্মীর তাতে কোনও ভাব বৈলক্ষণ নেই। রেজিস্ট্রি করা খামটা খুলে চিঠিটা তেরছা নজরে পড়ে বারান্দায় ফেলে রেখে পা ছড়িয়ে উকুন বাছতে বসল সরু চিরুনি দিয়ে। বাতাসে উড়ে–উড়ে ঘুড়ির মতো লাট খেয়ে চিঠিটা করুণ মুখে এসে উঠোনে দুর্গাপদর পায়ের পাতায় লেগে রইল। দুর্গাপদ উঠোনে বসে একটা ভাঙা মিটসেফের ডালায় কবজা লাগাচ্ছিল। ইংরিজিতে লেখা চিঠিটা বুঝতে একটু দেরি হল বটে, কিন্তু অবশেষে বুঝল এবং মাথাটা তখনই একটা পাক মারল জোর।
জামাইবাবাজি যে লোক খুব খারাপ নয় তা জানে বলেই দুর্গাপদ কটমট করে তাকাল মেয়ের দিকে। কিন্তু এসব তাকানো–টাকানোয় ইদানীং আর কাজ হয় না। কোনওদিন হতও না।
–বলি ব্যাপারটা কী, শুনছিস? হুঙ্কার দিল দুর্গাপদ।
লক্ষ্মী সূক্ষ্ম চিরুনিতে উঠে আসা চুলের গোছা আলোয় তুলে উকুন খুঁজতে খুঁজতে নির্বিকার গলায় বলে–দেখলে তো, আবার জিগ্যেস করছ কেন?
দুর্গাপদ বুঝল পুরুষকারে কাজ হবে না। গলা নরম করে বলল –স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া হয় সে তো দিন রাত্তিরের মতো সত্য। তা বলে উকিলের চিঠি কেন? তেমন কী হল তোদের?
লক্ষ্মীর মা ঘরেই ছিল। বরাবরের কুঁদুলি মেয়েছেলে। সেখান থেকেই গলা তুলে জিগ্যেস করল–কে উকিলের চিঠি দিল আবার?
–নবীন। হাল ছেড়ে দুর্গাপদ বলে।
–জামাই?
–তবে আর কে নবীন আছে?
লক্ষ্মীর মা কিছু মোটাসোটা। ফরসা গোলগাল প্রতিমার মতো চেহারা। বড়-বড় চোখে রক্ত হিম করা দৃষ্টিতে চাইতে পারে। দুর্গাপদর প্রাণ এই চোখের সামনে ভারী ধড়ফড় করে ওঠে।
ইংরেজি জানে না, তবু উঠোনে নেমে এসে চিঠিখানা হাতে নিয়ে একটু ঠান্ডা চোখে চেয়ে রইল সেটার দিকে। তারপর দুর্গাপদকে জিগ্যেস করল ডিভোর্স করবে নাকি?
–তাই তো লিখেছে।
–করলেই হল। আইন নেই?
–ডিভোর্সের কথা তো আইনেই আছে।
–তোমার কথা। ডিভোর্স হল বেআইনি ব্যাপার। কেউ ডিভোর্স করেছে জানতে পারলে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। জেল হয়।
লক্ষ্মীর মা তার বাপের বাড়ি থেকে যা-যা শিখে এসেছে তার ওপরে আজ পর্যন্ত কেউ তাকে কিছু শেখাতে পারেনি। অনেক ঠেকে দুর্গাপদ আর সে চেষ্টা করে না। তবু বলল –জেল দাওগে না। কে আটকাচ্ছে পুলিশে যেতে।
লক্ষ্মীর মা বড়-বড় চোখ করে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বলল –আমি যাব পুলিশের কাছে? তবে তুমি পুরুষমানুষ আছ কী করতে?
এ নিয়ে যখন লক্ষ্মীর মার সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক চলছিল তখন লক্ষ্মী ম্যাটিনি শোয়ে যাবে বলে রান্নাঘরে গিয়ে পান্তা খেতে বসল।
লক্ষ্মীর মায়ের বাঁজা নাম ঘুচিয়ে ওই লক্ষ্মীই জন্মেছিল, আর ছেলেপুলে হয়নি। একমাত্র সন্তান বলে আশকারা পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সে দুর্গাপদর কাছে যতটা তার চেয়ে ঢের বেশি তার মায়ের কাছ থেকে। সারাদিন মায়ে-মেয়ের গলাগলি ভাব, গুজগুজ ফুসফুস। দুটো মেয়েছেলে একজোট, অন্যধারে দুর্গাপদ এক পুরুষ। কীই বা করবে? চোখের সামনেই মেয়েটা বখে গেল।
লক্ষ্মী সিনেমায় বেরিয়ে যাওয়ার পর লক্ষ্মীর মা দুর্গাপদকে বলল –জামাই খারাপ নয়, কিন্তু ওর বাড়ির লোকেরা হাড়জ্বালানী। সবক’টাকে কোমরে দড়ি বেঁধে সদরে চালান দিয়ে আসবে। যাও। এ কী কথা! দেশে আইন নেই। কোর্ট–কাছারি নেই? পুলিশ জেলখানা নেই? ডিভোর্স করলেই হল?
এসব ক্ষেত্রে পুলিশের কাছে গিয়ে লাভ নেই তা দুর্গাপদ জানে। কিন্তু কোথায় যেতে হয় তা তারও মাথায় আসে না। সে তেমন লেখাপড়া জানে না, খুব ভদ্রসমাজের লোকও সে নয়। তবে ইলেকট্রিক মিস্তিরি হিসেবে গয়েশপুর থেকে কাঁচরাপাড়া অবধি তার ফলাও প্র্যাকটিস। বলতে কি উকিল, ডাক্তার, অফিসারদের মতোই তার গাহেককেও ঘুরে-ঘুরে আসতে হয়। বলতে নেই তার টাকা অঢেল। সে সাইকেলখানা নিয়ে ভরদুপুরে বেরিয়ে পড়ল।
বুদ্ধি দেওয়ার লোকের অভাব দুনিয়ায় নেই। একজন উঁদে এক উকিলের ঠিকানা মায় একটা হাতচিঠিও দিয়ে দিল। তাতে লাভ হল কি না দুর্গাপদ জানে না। প্রথমদিন জামাইয়ের উকিলের দেওয়া চিঠিটা পড়ে কুঁদে উকিল মোট মিনিটদশেক তার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পঁচিশটা টাকা নিল। কিন্তু তবু কোনও ভরসা দিতে পারল না।
দুর্গাপদ আজও এসেছে। বুকের মধ্যে সারাক্ষণ ঢিবঢ়িব, মুখ শুকনো গলা জুড়ে অষ্টপ্রহর এক তেষ্টা। মেয়েটা ঘাড়ে এসে পড়লে সমাজে মুখ দেখানো যাবে না। আর হারামজাদী শুধু যে ঘাড়ে এসে পড়বে তা তো নয়, ঘাড়ে বসে চুল পড়াবে। পাড়ায় ঢিটি ফেলে দেবে দু-দিনেই। স্বভাব জানে তো দুর্গাপদ। গতকাল সে লক্ষ্মীকে খুব সোহাগ দেখিয়ে বলেছিল–মা গো, শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বনিবনা করে থাকো গে যাও। আমি সঙ্গে যাব, বুঝিয়ে–সুঝিয়ে সব ঠিকঠাক করে দিয়ে আসব। থাকতে যদি পারো তো মাসে তিনশো টাকা করে হাত–খরচ পাঠাব তোমায়।