খাওয়া শেষ হলে তাকে আবার হাত ধরে তুলল তুষার। নিয়ে এল ঘরে।
–এই দ্যাখো আমার ঘরদোর। ওই যে মশারির নীচে শুয়ে আছে, ও আমার মেয়ে সোমা। এই দ্যাখো, ওর হাতে আঁকা ছবি। এই দ্যাখো ওয়ার্ডরোব, ফ্রিজিডেয়ার। ওই ড্রেসিং টেবিল। এই দ্যাখো, আরও কত কী–
ঘুরে-ঘুরে অরুণকে সব দেখায় তুষার।
মাঝে-মাঝে প্রশ্ন করে–এখানে এই সুন্দর ঘরে থাকতে ইচ্ছে করে না অরুণ? ইচ্ছে করে না এই সব জিনিসপত্রের মালিক হতে? তুমি আর চাও না কল্যাণীর মতো সুন্দর বউ? সোমার মতো মেয়ে।
অরুণের হাতে জোর ঝাঁকুনি দেয় তুষার–বলো অরুণ, ইচ্ছে করে না!
–অন্ধকার! ভীষণ অন্ধকার! পাগল বলে।
–কোথায়–কোথায় অন্ধকার?
–এইখানে।
বলে চারদিকে চায় পাগল।
–আর কোথায়?
–চারদিকে।
–থাকবে না অরুণ। থাকো থাকো। থেকে দ্যাখো।
পাগল কিছু বলে না।
হতাশ হয়ে তার হাত ছেড়ে দেয় তুষার!
পাগলটা আস্তে-আস্তে সদর পার হয়। সিঁড়ি ভাঙে। রাস্তা পেরিয়ে চলে যায় বকুল গাছটার তলায়। পা ছড়িয়ে বসে। পঁড়িতে হেলান দেয়। কুলকুল করে বয়ে চলে তার অন্যলগ্ন চিন্তার স্রোতস্বিনী। চোখ বুজে অনাবিল আনন্দে সে সেই স্রোত প্রত্যক্ষ করে।
উত্তরের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল তুষার। চেয়ে দেখে নিশ্চিন্তে বুকুল গাছের ছায়ায় আবার বসেছে পাগল। টুপটাপ বকুল ঝরছে তার মাথায়।
উত্তরের ব্যালকনি থেকে দৃশ্যটা দেখে তুষার। তার দুই চোখ ভরে আসে জলে।
–কিছুই চাও না অরুণ? বকুল গাছের তলায় তোমার হৃদয় জুড়িয়ে গেছে। হায় পাগল, ভালোবাসা নয়, এখন কেবল ভাতের জন্য তোমার বসে থাকা।
.
এখন আর কল্যাণীর কোনও সন্দেহ নেই। সে কাছ থেকে অরুণকে দেখেছে। সে কেঁপেছিল থরথর করে। দুঃখে ভয়ে উৎকণ্ঠায়। কিন্তু অরুণের মুখে সে দেখেছে বিস্মৃতি। তাকে আর মনে নেই অরুণের।
বড় শীত পড়েছে এবার। বকুল গাছ থেকে শুকনো পাতা খসে পড়ছে পাগলের গায়ে? ছোঁড়া জামা দিয়ে হু-হু করে উত্তরের হাওয়া লাগছে শরীরে। বড় দয়া হয়। মঙ্গলার হাত দিয়ে একটা পুরোনো কম্বল পাঠিয়ে দেয় কল্যাণী! পাগল সেই কম্বল মুড়ি দিয়ে নির্বিকার বসে থাকে।
মাঝে-মাঝে কল্যাণীরও বুক ব্যথিয়ে ওঠে। ভালোবাসার কথা মনে পড়ে। তুষার কি তাকে ভালবাসে এখনও! কে জানে? মাঝে-মাঝে উগ্র হিংসায় তাকে মন্থন করে তুষার। কখনও দিনের পরদিন থাকে নিঃস্পৃহ। আর ওই যে ভালোবাসার জন্য পাগল অরুণ–ও বসে আছে ভাতের প্রত্যাশায়। কল্যাণীকে চেনেও না।
তাহলে কী করে বাঁচবে কল্যাণী। বুক খামচে ধরে এক ভয়।
আবার, বেঁচেও থাকে কল্যাণী। বাঁচতে হয় বলে।
মাথার ওপর সব সময়ে উদ্যত নিস্তব্ধ ক্রেন হ্যামারটাকে টের পায় তুষার। অস্বস্তি! কখন যে ধম করে নেমে আসে। অকারণে বুক কাঁপে। ব্যথায় ককিয়ে উঠে তুষার।
ঠিক সকাল ন’টায় পিক ফেলতে এসে উত্তরের ব্যালকনি থেকে বকুল গাছটার গোড়ায় পাগলকে দেখে। দুজনে দুজনের দিকে চেয়ে থাকে।
কোম্পানি এবার উনিশ লক্ষ টাকা লাভ করেছে! ক্লান্তি বাড়ে। দিন শেষে তার শরীর জুড়ে নেমে আসে বাদুড়ের ডানার মতো অন্ধকার ক্লান্তি। তার ডালপালা ধরে কেবলই নাড়া দেয় এক তীব্র ইচ্ছা। নাড়া দেয়, নাড়া দিতে থাকে। অলীক ছুটি, মিথ্যা অবসর, অবিশ্বাস্য মুক্তির জন্য খামোকা আকুল হয় সে। পৃথিবী ঘুরে যাচ্ছে। বয়ে যাচ্ছে সময়। বয়স বাড়ছে।
তুষার অস্থির হয়। অস্থিরতা নিয়ে বেঁচে থাকে।
.
ঠিক যেন এক নদীর পাড়ে বসে আছে পাগল। কী সুন্দর আবছায়া নদীটি। চারদিকে আধো আলো আধো অন্ধকার। অনন্ত সন্ধ্যা। নদীটি বয়ে যায় অবিরল। স্মৃতি বিস্মৃতিময় তার স্রোত। পাগল প্রত্যক্ষ করে। ক্লান্তি আসে না। বকুলের গাছ থেকে পাতা খসে পড়ে, কখনও ফুল, বৃষ্টি আসে, ঝড় বয়ে যায়, আবার দেখা দেয় রোদ। তবু আবছায়ায় নদীটি বয়ে যায়। বয়ে যায়।
পাগল বসে থাকে।
ওষুধ
উকিলবাবু এখনও আসেননি। মক্কেলরা বসে-বসে মশা মারছে।
দুর্গাপদ খুবই ধৈর্যশীল লোক। সে জানে, বড় অফিসার, বড় ডাক্তার, বড় উকিল ধরলে ধৈর্য রাখতে হয়। যে যত বড় সে তত ঘোরাবে।
দুর্গাপদ রাস্তা পেরিয়ে উলটোদিকের পানের দোকানে গিয়ে লেমনেড চাইল। তেষ্টা পেয়ে রয়েছে অনেকক্ষণ। উকিলবাবুর বাড়ির চাকরের কাছে জল চাইলে দিত নিশ্চয়ই, কিন্তু চাইতে কেমন ভয়-ভয় আর লজ্জা–লজ্জা করছিল তার।
দোকানদার বুড়ো মানুষ। তার দোকানটাও তেমনি কিছু বড় দোকান নয়। ছোট-খাটো, গরিবগুর্বোর দোকান। বিড়ি চাও আছে, পিলাপাতি কালাপাতি চমনবাহার মোহিনী জরদা দেওয়া পান পাবে, ক্যাপস্টান গোল্ড ফ্লেক চাও তাও মজুদ, কম দামি কোল্ড ড্রিংকস রাখতে হয় বলে তাও রাখা, কিন্তু বেশি বায়নাক্কা হলে অন্য দোকান দেখতে হবে।
বুড়ো তার লাল বাক্স খুলে বরফে ঠান্ডা বোতল অনেক বেছে গুছে একটা বের করে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে-এরকম ঠান্ডা হলে চলবে?
অন্যমনস্ক দুর্গাপদ বলে–হুঁঃ।
লজেনচুসের গন্ধওয়ালা ঠান্ডা, মিস্টি ঝাঁজালো জলটা খেতে গিয়ে বুকের জামা ভিজে গেল দুর্গাপদর। কাগজের নল দিয়ে টেনে সে এসব খেতে পারে না। চুরুক–চুরুক খাওয়া তার পছন্দ নয়। ঘঁৎঘঁৎ করে না গিললে তৃপ্তিটা পায় না।
জলটা খেতে-খেতে চেয়ে আছে উলটো দিকের বাড়িটার দিকে। না উকিলবাবু এখনও আসেননি।