আবার ফিরে আসে ঘরে। বাতি জ্বালে। পাতলা নেট-এর মশারির ভিতর দিয়ে তৃষিত চোখে ঘুমন্ত কল্যাণীকে দেখে। তার বুক ঘেঁষে জড়সড়ো হয়ে শুয়ে আছে বাচ্চা সোমা। সোমার মাথার কাছে দুটো কাগজ, তাতে ছবি আঁকা। একটাতে নদী, নৌকো, গাছপালা। অন্যটাতে খোঁপাসুষ্ঠু একটা মেয়ের মুখ, নীচে লেখা সোমা। অনেকক্ষণ ছবি দুটোর দিকে চেয়ে রইল তুষার। একটা শ্বাস ফেলল।
কল্যাণী শান্তভাবে ঘুমোচ্ছে। মুখে নিশ্চিন্ত কমনীয়তা। চেয়ে থাকে তুষার। আস্তে-আস্তে বলে –কী করে ঘুমোও?
.
–চলো, বাইরে যাই। কিছুদিন ঘুরে আসি। এক সকালে চায়ের টেবিলে কল্যাণীকে এই কথা বলল অবসন্ন তুষার।
.
–চলো। কোথায় যাবে?
–কোথাও। দূরে। সমুদ্রে বা পাহাড়ে।
–পুরীর সমুদ্র তো দেখেছি। দার্জিলিং শিলং-ও দেখা।
–অন্য কোথাও। অচেনা নির্জন জায়গায়। বলে তুষার। কিন্তু সে জানে মনে-মনে, ঠিক জানে –যাওয়া বৃথা। সে কতবার গেছে বাইরে, সমুদ্রে, পাহাড়ে। তার মধ্যে মুক্তি নেই, জানে। মুক্তি এখানেই আছে। আছে দুর্লভ ইচ্ছাপূরণ। খুঁজে দেখতে হবে।
তবু তারা বাইরে গেল। এক মাস ধরে তারা ঘুরল নানা জায়গায়। পাহাড়ে, সমুদ্রেও। ফিরে এল একদিন।
পাগলটা ঠিক বসে আছে। উত্তরের ব্যালকনিটার দিকে চেয়ে।
মাঝে-মাঝে কাজের মধ্যেও তুষার হঠাৎ বলে ওঠে না নাঃ। বলেই চমকায়। কীসের না? কেন না?
ছোঁকরা স্টেনোগ্রাফারটিকে জরুরি ডিকটেশন দিতে দিতে বলে ওঠে–নাঃ–নাঃ। স্টেনোগ্রাফারটি বিনীতভাবে থেমে থাকে।
তুষার চারিদিকে চায়। অদৃশ্য মশারির মতো কী একটা ঘিরে আছে চারদিকে। ওটা কী! ওটা কেন! কী আছে ওর বাইরে?
নির্জন শেক্সপিয়ার সরণি ধরে হাঁটে তুষার, হাঁটে নির্জন ময়দানে, হাঁটে ভিড়ের মধ্যে। বহু দূরে-দূরে চলে যায়। কিন্তু সেই অলীক মশারির বাইরে কিছুতেই যেতে পারে না। ট্যাক্সিতে উঠে বলে জোরে চালাও ভাই। আরও জোরে–আরও জোরে…
ট্যাক্সি উড়ে যায়। তবু চারদিকে অলীক সূক্ষ্ম জাল।
হতাশ হয়ে ভাবে–আছে কোথাও বাইরে যাওয়ার পথ। খুঁজে দেখতে হবে। চোখ বুজে ভাবে। উটের মতো একটা ক্রেন হ্যামার আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, পিছনে বিশাল লোহার কাঠামো, সেইখানে একটা লোহার বিমে নুড়ি ছুঁড়ে শব্দ তুলছে বাচ্চা একটা ছেলে।
এক-একদিন রাতে ভাত দিতে নেমে আসে তুষার। ভাত রেখে একটু দূরে দাঁড়ায়। সিগারেট খায়।
–অরুণ, তোমার কি ইচ্ছে করে আমার ঘরে যেতে?
পাগল খায়। উত্তর দেয় না।
–ইচ্ছে করে না কল্যাণীকে একবার কাছ থেকে দেখতে?
পাগল খায়। কথা বলে না।
–জানতে চাও না সে কেমন আছে?
ফিরেও তাকায় না পাগল। খেয়ে যায়।
–একদিন তোমাকে নিয়ে যাব আমাদের ঘরে! যাবে অরুণ?
একজন প্রতিবেশী পথ চলতে-চলতে দাঁড়ায়। হঠাৎ বলে–আপনার বড় দয়া। রোজ দেখি দুবেলা পাগলটাকে আপনারা ভাত দেন। আজকাল কেউ এতটা করে না কারও জন্য! আমরা আমাদের ছেলে মেয়েদের কাছে আপনার কথা বলি।
কৌতূহলে প্রশ্ন করে তুষারকী বলেন?
–বলি, ওইরকম মহাপ্রাণ হয়ে ওঠো। আমরা তো নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের দ্বারা কিছু হল না পৃথিবীর। কাছাকাছি আপনি আছেন–এটাই আমাদের বড় লাভ।
তুষার মূক হয়ে যায়। এ কেমন মিথ্যা প্রচার! দয়া! দয়া কথাটা কেমন অদ্ভুত! এমন কথা সে তো ভাবেওনি!
কিন্তু ভাবে তুষার! ভাবতে থাকে। কাজকর্মের ফাঁকে-ফাঁকে তেমনি বলে ওঠেনা না। চমকায়! জালবদ্ধ এক অস্থিরতায় অন্যমনস্ক হয়ে যায়। ঝড়বৃষ্টি হলে এখনও মাঝে-মাঝে ক্রেন হ্যামারটা ধম করে নেমে আসে। জেগে উঠে যন্ত্রণায় বুক চেপে কাতরতার শব্দ করে সে।
এত রাতে সত্যিই তুষার কল্যাণীকে ভাত বাড়তে বলে নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। রাস্তা পার হয়ে এল বকুল গাছটার তলায়।
–চলো অরুণ। একবার আমার ঘরে চলো। কোনও দিন তুমি যেতে চাওনি। আজ চলো। আমি নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে। আজ তোমার নিমন্ত্রণ।
বলে হাত ধরল পাগলের। পরিষ্কার সুন্দর হাতে ধরল নোংরা হাতখানা।
কে জানে কী বুঝল পাগল, কিন্তু উঠল!
সাবধানে তার হাত ধরে রাস্তা পার করল তুষার। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল। দাঁড়াল এসে খাবার ঘরের দরজায়।
–কল্যাণী, দ্যাখো কাকে এনেছি।
–কল্যাণীর হাত থেকে পড়ে গেল একটা চামচ। ভয়ঙ্কর ঠিঠিন শব্দ হল। কেঁপে উঠল কল্যাণীর বুক। শরীর কাঁপতে লাগল। ভয়ে সাদা হয়ে গেল তার ঠোঁট।
–মা গো! চিৎকার করল সে। নরম গলায় তুষার বলল –ভয় নেই, ভয় নেই কল্যাণী। তুমি খাবার সাজিয়ে দাও। অরুণ আজ আমার অতিথি।
নীরবে দাঁড়িয়ে রইল কল্যাণী। জলে তার চোখ ভরে গেল। তুষারের হাতে–ধরা পাগল নতমুখে দাঁড়িয়ে রইল।
এত কাছ থেকে অরুণকে অনেকদিন দেখেনি কল্যাণী। কী বিপুল দারিদ্র্যের চেহারা। খালাসিদের যে নীল জামাটা ওর গায়ে তা বিবর্ণ হয়ে ছিঁড়ে ফালা–ফালা। খাকি প্যান্টের রং পালটে ধূসর হয়ে এসেছে। কী পিঙ্গল ওর ভয়ঙ্কর রাঙা চুল। পৃথিবীর সব ধুলো আর নোংরা ওর গায়ে লেগে আছে। কেবল তখনও অকৃপণ, সুন্দর, সুগন্ধ বকুল ফুলে ছেয়ে আছে ওর মাথায় জটায় ঘাড়ে।
কাঁপা হাতে খাবার সাজিয়ে দিল কল্যাণী। তার চোখ দিয়ে অবিরল জল গড়িয়ে পড়ছে। পাগল তার দিকে তাকালই না। চোখ নীচু রেখে খেয়ে যেতে লাগল।
মাঝে-মাঝে বিড়বিড় করে তুষার বলছিল–খাও অরুণ, খাও।