সে ডাক শুনতে পেল তুষার। খেতে-খেতে জিগ্যেস করল–পাগলটাকে রাতের খাবার দাওনি?
–কী করে দেব। রোজ মঙ্গলা রাতে একবার আসে খাবারটা দিয়ে আসতে। আজ আসেনি, ওর ছেলের অসুখ।
–আমার কাছে দাও, দিয়ে আসছি।
–তুমি দেবে? অবাক হয় কল্যাণী।
–নয় কেন?
–শুধু দিয়ে আসা তো নয় বাবুর খাওয়া হলে এঁটো বাসন নিয়ে আসতে হবে। পাগলের এঁটো তুমি ছোঁবে?
তুষার হাসল–তোমার জন্য ও অনেক দিয়েছে ওর জন্য আমরা কিছু দিই—
থালায় নয়, একটা খবরের কাগজে ভাত বেড়ে দিল কল্যাণী। তুষার সেই খবরের কাগজের পোঁটলা নিয়ে বকুল গাছটার তলায় গেল।
পাগলটা তুষারের দিকে তাকালও না। হাত বাড়িয়ে পেঁটলাটা নিল। খুলে খেতে লাগল গোগ্রাসে।
একটুদূরে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা সিগারেট খেতে-খেতে দেখতে লাগল তুষার।
–খাওয়া ছাড়া তুমি আর কিছু বোঝো না অরুণ?
পাগলটা মুখ তুলল না। তার খিদে পেয়েছে। সে খেতে লাগল।
–ওইখানে, ওই ব্যালকনিতে মাঝে-মাঝে কল্যাণী এসে দাঁড়ায়। তাকে দেখ না? তার বাঁ গালে সেই সুন্দর কালো আঁচিলটা এখনও মাছির মতো বসে থাকে দ্যাখো না? এখনও আগের মতোই ভারী তার চোখের পাতা, দীর্ঘ গ্রীবা, এখনও তেমনি উজ্জ্বল রঙ। চেয়ে দ্যাখো না অরুণ?
পাগল গ্রাহ্য করে না। তার খিদে পেয়েছে। সে খাচ্ছে।
আকাশে মেঘ করেছে খুব। তুষার মুখ তুলে দেখল! পিঙ্গল আকাশ, বাতাস থম ধরে আছে। ঝড় উঠবে। এই ঝড়বৃষ্টির রাতেও বাইরেই থাকবে পাগল। হয়তো কোনও গাড়ি বারান্দার তলায় গিয়ে দাঁড়াবে। ঝড় খাবে। আর অবিরল নিজের মধ্যবর্তী বিচ্ছিন্ন চিন্তার এক স্রোতস্বিনীকে করবে প্রত্যক্ষ।
–তোমার কোনও নিয়ম না মানলেও চলে, তবু কেমন নিয়মে বাঁধা পড়ে গেছ অরুণ। তোমার মুক্তি নেই?
ডাল তরকারিতে মাখা কাগজটা ছিঁড়ে গেছে। ফুটপাথের ধুলোয় পড়েছে ভাত। পাগল তার নোংরা হাতে, নখে খুঁটে খাচ্ছে। একটা রাস্তার কুকুর বসে আছে অদূরে, আর দুটো দাঁড়িয়ে আছে। তুষার চোখ ফিরিয়ে নিল।
ঘর অন্ধকার হতেই সেই লোহার কাঠামো, তার ভিতরকার ঝুঁঝুকো আঁধার আর একবার দেখা গেল। লোহার বিমের গায়ে নুড়ি পাথরের টুং–টুং শব্দ। অবিরল অবিশ্রাম। বুকে খামচে ধরে মুক্তির তীব্র সাধ। কীসের মুক্তি? কেমন মুক্তি? কে জানে! কিন্তু তার ইচ্ছা উত্তপ্ত পিরদের মতো লাফিয়ে ওঠে।
আকুল আগ্রহে সে আবার বাতি জ্বালে। কল্যাণী বলে–কী হল?
উত্তেজিত গলায় তুষার ডাকে–এসো তো, এসো তো কল্যাণী।
তারপর সে নিজেই হাত বাড়িয়ে মশারির ভিতর থেকে টেনে আনে কল্যাণীকে। আনে নিজের বিছানায়। কল্যাণী ঘেমে ওঠে। উজ্জ্বল আলোয় কল্যাণীকে পাগলের মতো দেখে তুষার, চুমু খায়, তীব্র আগ্রহে রিরংসায় তাকে মন্থন করে। বিড়বিড় করে বলে–কেন তোমার জন্যে ও পাগল? কী আছে তোমার মধ্যে? কী সেই মহামূল্যবান। আমাকে দিতে পারো তা?
বৃথা। সব শেষে ঘোরতর ক্লান্তি নামে।
এইটুকু। আর কিছু নয়!
ওরা ঘুমোয়। বাইরে ঝড়ের প্রথম বাতাসটি বয়ে যায়! প্রথম বৃষ্টির ফোঁটাটি একটি পোকার মতো উড়ে এসে বসে পাগলটার ঠোঁটে। বসে-বসে ঝিমোয় পাগল। তার রক্তবর্ণ চুলগুলি নিয়ে খেলা করে বাতাস। বিদুৎ উদ্ভাসিত করে তার মুখ। তার মাথায় অবিরল বকুল ঝরিয়ে দিতে থাকে গাছ।
বহু উঁচু থেকে ক্রেন হ্যামারটা ধম করে নেমে আসে। চমকে উঠে বসে তুষার। বুকের ভিতরটা ধকধক করতে থাকে। এত জোরে বুক কাঁপতে থাকে যে দুহাতে বুক চেপে ধরে কাতরতার একটা অস্ফুট শব্দ করে সে।
কীসের শব্দ ওটা? অন্ধকারে উঁচু উটের গ্রীবার মতো নিস্তব্ধ ক্রেন হ্যামারটা সে কোথায় দেখেছে? কবে? বাইরে ঝড়ের প্রচণ্ড শব্দ বাড়ি–বাড়ি কড়া নেড়ে ফিরছে। একা-একা উল্লাসে ফেটে পড়ছে ঝড়। সেই শব্দে মাঝরাতে ঘুমভাঙা তুষার চেয়ে থাকে বেভুল মানুষের মতো। বুক কাঁপে। আস্তে-আস্তে মনে পড়ে একটা বিশাল লোহার কাঠামো, তাতে ঘনায়মান অন্ধকার, উঁচু ক্রেন হ্যামার। অমনি ব্যথিয়ে ওঠে বুক। তীব্র মুক্তির ইচ্ছায় ছটফট করতে থাকে সে। তার মন বলে–চলো সমুদ্রে। চলো পাহাড়ে! চলো ছড়িয়ে পড়ি।
বুক চেপে ধরে তুষার। আস্তে-আস্তে হাঁপায়।
বাইরে খর বিদুৎ দিয়ে মেঘ স্পর্শ করে মাটিকে।
এই ঝড়ের রাতে তুষারের খুব ইচ্ছে হয়, একবার উঠে গিয়ে পাগলটাকে দেখে আসে।
কিন্তু ওঠে না। নিরাপদ ঘরে ভীরু গৃহস্থের মতো সে বসে থাকে। বাইরে ভিখিরি, পাগলদের ঘরে ঝড় ফেটে পড়ে। তাদের ঘিরে নেমে আসে অঝোর বৃষ্টির ধারা।
পরদিন আবার বুকলতলায় পাগলকে দেখা যায়। অফিস যাওয়ার আগে পানের পিক ফেলতে এসে উত্তরের ব্যালকনি থেকে তাকে দেখে তুষার। একটু বেলায় কল্যাণী আসে। দ্যাখে। অভ্যাস।
কাজের মধ্যে ডুবে থাকে সে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে তুষার মাঝে-মাঝে অস্বস্তি বোধ করে। অফিসের পর বাদুড়ের পাখনার মতো অন্ধকার ক্লান্তি নামে চার ধারে। অনেক দূর হেঁটে যায় তুষার। ট্যাক্সিতে ওঠে, কোনওদিন ওঠে না। হেঁটে-হেঁটে চলে যায় বহু দূর। কী একটা কাজ বাকি রয়ে গেল জীবনে! করা হল না! এক রোমাঞ্চকর আনন্দময় মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল আমার। পেলাম না। অস্থিরতা বেড়ালের থাবার মতো বুক আঁচড়ায়।
মাঝে-মাঝে রাতে ঘুম ভেঙে যায় তার। উঠে বসে। সিগারেট খায়। জল পান করে। কখনও বা উত্তরের দরজা খুলে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। মোমবাতির মতো স্থির দাঁড়িয়ে আছে সাদা বাতিস্তম্ভ, তার নীচে বকুলগাছ। তার ছায়া। অন্ধকারে একটা পুঁটলির মতো পড়ে আছে পাগল।