তুষার হাসল–চিনতে পারছ না?
নিনি ওপরের দাঁতে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে একটু ভাবল। তুষার দেখল ডান দিকের একটা দাঁত নেই। সেই দাঁতটা বাঁধানো, দাঁতের রং মেলেনি। পাঁচ বছরে এইটুকু পালটেছে নিনি।
–আমি তুষার।
নিনির মুখ হঠাৎ উদ্ভাসিত হয়ে গেল।
এবার বাংলায়–আঃ, তুমি কি সেই রকম দুষ্টু আছ। বুড়ো হওনি?
–আগে বলল , তুমি সেই নিনি আছ কি না! তোমার স্বামী পুত্র হয়নি তো! হয়ে থাকলে দোরগোড়া থেকেই বিদায় দাও।
নিনি ঠোঁট উলটে বলল –আমার ওসব নেই। এসো।
ঘরে সেই রঙিন কাগজে ছাওয়া দেওয়াল, ভাড়া করা ওয়ার্ডরোব, মেয়েলি আসবাবপত্র। এখনও সেন্ট–পাউডার ফুলের গন্ধ ঘরময়। বিছানার মাথার কাছে গ্রামোফোন, টেবিলে রেডিও আর গিটার।
নিনি কয়েক পলক তাকিয়ে বলল –তুমি একটুও বদলাওনি।
–তুমিও।
কিন্তু তুষারের তীব্র ইচ্ছাটা এখনও অস্থির অন্ধের মতো বেরোবার পথ খুঁজছে! সে কি এইখানে তৃপ্ত হবে? হবে তো? উত্তেজনায় অস্থিরতায় সে কাঁপতে থাকে।
ওয়ার্ডরোবের পাল্লা খুলে সাবধানে গুপ্ত জায়গা থেকে একটা দামি মদের বোতল বের করে নিনি, তারপর হেসে বলে–এই মদ কেবল আমার বিশেষ অতিথিদের জন্য।
এই সবই তুষারের জানা ব্যাপার। ওই যে গোপনতার ভান করে দামি বোতল বের করা ওটুকু নিনির জীবিকা। তুষারের মনে আছে নিনি বারবার তাকে এই বলে সাবধান করে দিত–মনে রেখো এটা ভদ্র জায়গা। আর, আমি বেশ্যা নই। মাতাল হয়ো না, হুল্লোড় করো না।
তুষার হাসল। সে বারবার নিনির কাছে মাতাল হয়ে হুল্লোড় করেছে।
তুষার আজ মাতাল হওয়ার জন্য উগ্র আগ্রহে প্রস্তুত ছিল। একটুতেই হয়ে গেল। তখন তীব্র মাদকতায় একটা গৎ গিটারে বাজাচ্ছিল নিনি। ওত পেতে অপেক্ষা করছিল তুষার। বাজনার সময়ে নিনিকে ছোঁয়া বারণ। বাজনা থামলে তারপর–
ভিতরে তীব্র ইচ্ছেটা গিটারের শব্দে তীব্রতর হয়ে উঠেছে।
মুক্তি। সামনেই সেই মুক্তি। চোখের সামনে আবার সেই খাড়া বিশাল লোহার কাঠামোতে ঘনায়মান অন্ধকার, লোহার বিমে নুড়ির শব্দ।
বাজনা থামতেই বাঘের মতো লাফ দিল তুষার।
তীব্র আশ্লেষ ইচ্ছা আনন্দময় আবরণ উন্মোচন, তারই মাঝখানে হঠাৎ ব্যাথায় ককিয়ে ওঠে নিনি–থামো, থামো, আমার বড় ব্যথা–
তুষার থামে–কী বলছ?
নিনি ঘর্মাক্ত মুখে ব্যথায় নীল মুখ তুলে বলে–এইখানে বড় ব্যথা–
পেটের ডান ধার দেখিয়ে বলে–গত বছর আমার একটা অপারেশন হয়েছিল। অ্যাপেন্ডিসাইটিস–
তুষারের লিত হাত পড়ে যায়। পাঁচ বছরে অনেক কিছু নষ্ট হয়ে গেছে। সবকিছু কি আর ফিরে পাওয়া যায়?
সময় পেরিয়ে গেল, তুষার ফিরল না।
বিকেলে চুল বেঁধেছে কল্যাণী। সেজেছে। চায়ের জল চড়িয়েছিল, ফুটে–ফুটে সেই জল শুকিয়ে এসেছে। গ্যাসের উনোন নিভিয়ে কল্যাণী ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। উত্তরের ব্যালকনি, উলটোদিকে ফুটপাথে সেই বকুলগাছ, গাছতলায় ধুলো–মাখা আকীর্ণ ফুলের মধ্যে বসে আছে। পাগলটা। একটু দূরে বসে একটা রাস্তার কুকুর পাগলটাকে দেখছে।
দৃশ্যটাকে করুণ বলা যায়। আবার বলা যায় না। অরুণকে নিয়ে এখন আর ভাববার কিছু নেই। এখন এক রাস্তার পাগল। মুক্ত পুরুষ।
এখন ব্যালকনিটা অন্ধকার। পিছনে ঘরের আলো। তাই রাস্তা থেকে কল্যাণীকে ছায়ার মতো দেখায়। পাগলটা মুখ তুলে ছায়াময়ী কল্যাণীকে দেখে। টুপটাপ বুকুল ঝরে পড়ে। অবিকল পাগলটা হাত বাড়িয়ে ফুল তুলে নেয়। লম্বা নোংরা নখে ছিঁড়ে ফেলতে থাকে ফুল। রাত বাড়ছে। তার খিদে পাচ্ছে।
পুরোনো বাড়িটার সিঁড়ি বেয়ে অনেকক্ষণ হল রাস্তায় নেমে এসেছে তুষার। কখনও নির্জন শেক্সপিয়র সরণি, কখনও চলাচলকারী মানুষের মধ্যে চৌরঙ্গি রোড ধরে বহুক্ষণ হাঁটল সে। এখনও মাঝে-মাঝে উঁচু বাড়ির লোহার কাঠামোর ভিতরে ঘনায়মান অন্ধকার তার মনে পড়ছে, মাঝে-মাঝে শুনতে পাচ্ছে, নেপথ্যে কে যেন নুড়ি ছুঁড়ে মারছে লোহার বিমের গায়ে। তার মন বলছে, এখানে নয় এখানে নয়। চলো সমুদ্রে যাই। কিংবা চলো পাহাড়ে। ছুটি নাও। মুক্তি নাও। বৃথা বয়ে যাচ্ছে সময়।
কেন যে এই ভূতুড়ে মুক্তির ইচ্ছা? সে কি চাকরি করতে-করতে ক্লান্ত? সে কি সংসারের একঘেয়েমি আর পছন্দ করছে না? কল্যাণীর আকর্ষণ সব কি নষ্ট হয়ে গেল?
বেশ রাত করে সে বাড়ি ফিরল। সোমা ঘুমিয়ে পড়েছে। কল্যাণী দরজা খুলে মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
–মদ খেয়েছ?
–খেয়েছি।
–আর কোথায় গিয়েছিলে?
–কোথায় আবার?
কল্যাণী বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদতে থাকে।
ভারী বিরক্ত হয় তুষার কাঁদছ কেন? মদ তো আমি প্রথম খাচ্ছি না? আমদের যা স্ট্রেইন হয় তাতে না খেলে চলে না-
কাঁদতে–কাঁদতেই হঠাৎ তীব্র মুখ তোলে কল্যাণী–শুধু মদ! মেয়েমানুষের কাছ যাওনি? তোমার ঠোঁটে গালে শার্টে লিপস্টিকের দাগ তোমার গায়ে সেন্টের গন্ধ যা তুমি জন্মে মাখো না-
তুষার অপেক্ষা করতে লাগল। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার নেই।
অনেক রাত হল আরও। বেশ পরিশ্রম করতে হল তুষারকে। তারপর রাগ ভাঙল কল্যাণীর। উঠে ভাত দিল।
বাইরে বকুল গাছের তলায় তখন পাগলটা অনেকগুলি ফুল নখে ছিঁড়ে স্কুপ করেছে। উগ্র চোখে সে চেয়ে আছে অন্ধকার ব্যালকনিটার দিকে। ঘরের দরজা বন্ধ। তার খিদে পেয়েছে। মাঝে-মাঝে সে চেঁচিয়ে বলছে–অন্ধকার। ভীষণ অন্ধকার! কোই হ্যায়।