ঘড়ির কাঁটা জলস্রোতের মতো বয়ে চলেছে। কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ, বারবার ওপরে উঠে আসে আরও ওপরে উঠে যায়। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ নেমে আসে, নেমে যায়। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে। সময় যাচ্ছে বয়ে।
শিশু মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমাবার আগে ক্ষীণকণ্ঠে একবার বলে–মা, বাবা–
বাক্যটা শেষ করে না। বউটি আগ্রহে শুনবার চেষ্টা করে বাক্যটি। শিশুরা তো ভগবান, ওদের কথা অনেক সময় ফলে যায়। কিন্তু শিশু মেয়েটি বাক্যটা শেষ করে না। বউটির বুক কাঁপে।
.
এবার বউটি একা। জানালার পাশে। শিকের ফাঁকে চেপে রাখা মুখ চোখের জলে ভাসে! ন’টা বেজে গেল বুঝি! বউটি আস্তে-আস্তে বুঝতে পারে, তার মানুষটা আর আসবে না। অমন মানুষটার নানা চিহ্ন তার মনে পড়ে। কথা বলার সময় ওপরের ঠোঁটটা বাঁ-দিকে একটু বাঁক খায়, লোকটার দাঁত একটু উঁচু, গাল ভাঙা, কপালের ডান দিকে একটা আঁচিল, সাবধানী ভীতু এবং খুঁতখুঁতে মানুষ। বড় মেয়ে ন্যাওটা আর বউ–ন্যাংলা। এমনিতে এসব মনে পড়ে না, কিন্তু এখন বড় মনে পড়ছে। বউটি হাপুস হয়ে কাঁদতে থাকে।
সদর খোলা ছিল। সিঁড়িতেও শব্দ হয়নি।
অন্ধকার ঘরের ভিতর একটা ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়ায়! প্রশ্ন করে–এ কী, সব অন্ধকার কেন?
চমকে ওঠে বউটি, বুঝতে পারে, মানুষটা ফিরেছে।
–কী হয়েছিল শুনি?
–আর বোলো না, সত্যকে মনে আছে?
–কে সত্য?
–কোন্নগরের। আমার বুজুম ফ্রেন্ড। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ স্ট্রোক হয়ে মারা গেল। খবর পেয়ে অফিস থেকেই গিয়েছিলুম। মনটা যে কী খারাপ লাগছে।
বউটি আলো জ্বালে, ঘরদোর আবার হেসে ওঠে! তারা খাওয়াদাওয়া সারে। হাসে গল্প করে।
মানুষটা বারবারই তার মৃত বন্ধুর কথা বলে। বউটি বলে আহা গো।
কিন্তু বউটি তবু সুখীই বোধ করে। কারণ তার মানুষটা ফিরেছে। মানুষটা ফিরেছে। মানুষটা বেঁচে আছে।
আমরা
সেবার গ্রীষ্মকালের শেষদিকে দিন চারেক ইনফ্লুয়েঞ্জাতে ভুগে উঠলেন আমার স্বামী। এমনিতেই তিনি একটু রোগা ধরনের মানুষ, ইনফ্লুয়েঞ্জার পর তাঁর চেহারাটা আরও খারাপ হয়ে গেল। দেখতাম তাঁর হনুর হাড় দুটো গালের চামড়া কুঁড়ে বেরিয়ে আছে, গাল বসা, চোখের নীচে কালি, আর তিনি মাঝে-মাঝে শুকনো মুখে ঢোক গিলছেন–কণ্ঠাস্থিটা ঘনঘন ওঠা–নামা করছে। তাঁকে খুব অন্যমনস্ক, কাহিল আর কেমন যেন লক্ষ্মীছাড়া দেখাত। আমি তাঁকে খুব যত্ন করতাম। বীট গাজর সেদ্ধ, টেংরির জুস, দু-বেলা একটু-একটু মাখন, আর রোজ সম্ভব নয় বলে মাঝেমধ্যে এক-আধটা ডিমের হাফবয়েল তাঁকে খাওয়াতাম। কিন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জার এক মাস পরেও তাঁর চেহারা ভালো হল না, বরং আরও দুর্বল হয়ে গেল। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে তিনি ভয়ঙ্কর হাঁফাতেন, রাত্রিবেলা তাঁর ভালো ঘুম হত না, অথচ দেখতাম সকালবেলা চেয়ারে বসে চায়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে তিনি ঢুলছেন, কষ বেয়ে নাল গড়িয়ে পড়ছে। ডাকলে চমকে উঠে সহজ হওয়ার চেষ্টা করতেন বটে, কিন্তু স্পষ্টই বোঝা যেত যে তিনি স্বাভাবিক নেই। বরং অন্যমনস্ক এবং দুর্বল দেখাচ্ছে তাঁকে।
ভয় পেয়ে গিয়ে আমি জিগ্যেস করলাম–তোমার কী হয়েছে বলো তো!
তিনি বিব্রতমুখে বললেন,–অনু, আমার মনে হচ্ছে ইনফ্লুয়েঞ্জা আমার এখনও সারেনি। ভিতরে-ভিতরে আমার যেন জ্বর হয়, হাড়গুলো কটকট করে, জিভ তেতো–তেতো লাগে। তুমি আমার গা–টা ভালো করে দ্যাখো তো!
গায়ে হাত দিয়ে দেখি গা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি ঠান্ডা। সে কথা বলতেই তিনি হতাশভাবে হাত উলটে বললেন–কী যে হয়েছে ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার বোধহয় একটু একসারসাইজ করা দরকার। সকাল বিকেল একটু হাঁটলে শরীরটা ঠিক হয়ে যাবে।
পরদিন থেকে খুব ভোরে উঠে, আর বিকেলে অফিস থেকে ফিরে তিনি বেড়াতে বেরোতেন। আমি আমাদের সাত বছর বয়সের ছেলে বাপিকে তাঁর সঙ্গে দিতাম। বাপি অবশ্য বিকেলবেলা খেলা ফেলে যেতে চাইত না, যেত সকালবেলা। সে প্রায়ই এসে আমাকে বলত–বাবা একটুও বেড়ায় না মা, পার্ক পর্যন্ত গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ে, আর রেলিঙে ঠেস দিয়ে ঢুলতে থাকে। আমি বলি, চলো বাবা, লেক পর্যন্ত যাই, বাচ খেলা দেখে আসি, আমাদের স্কুলের ছেলেরাও ওখানে ফুটবল প্রাকটিস করে, কিন্তু বাবা রেললাইন পারই হয় না। কেবল টুলটুল চোখ করে বলে, তুই যা, আমি এখানে দাঁড়াই, ফেরার সময়ে আমাকে খুঁজে নিস।
আমাদের স্নানঘরটা ভাগের। বাড়িওয়ালা আর অন্য এক ভাড়াটের সঙ্গে। একদিন সকালবেলা অফিসের সময়ে অন্য ভাড়াটে শিববাবুর গিন্নি এসে চুপিচুপি বললেন–ও দিদি আপনার কর্তাটি যে বাথরুমে ঢুকে বসে আছেন, তারপর আর কোনও সাড়া শব্দ নেই। আমার কর্তাটি তেল মেখে কখন থেকে ঘোরাফেরা করছেন, এইমাত্র বললেন–দেখি তো, অজিতবাবু তো কখনও এত দেরি করে না-
শুনে ভীষণ চমকে উঠলাম। তাড়াতাড়ি গিয়ে আমি বাথরুমের দরজায় কান পাতলাম। কিন্তু বাথরুমটা একদম নিশ্চুপ। বন্ধ দরজার ওপাশে যে কেউ আছে তা মনেই হয় না। দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকলাম–ওগো, কী হল–
তিনি বললেন–কেন?
–এত দেরি করছ কেন?
তিনি খুব আস্তে, যেন আপনমনে বললেন–ঠিক বুঝতে পারছি না-তারপর হুড়মুড় করে জল ঢেলে কাক–স্নান সেরে তিনি বেরিয়ে এলেন।