বিকেলের আলো জানালার শার্সিতে ঘরে আসে। তখন এয়ারকন্ডিশন করা ঘরখানায় সিগারেটের ধোঁয়া জমে ওঠে। কুয়াশার মতো আবছা দেখায় ঘরখানা। তখন খুব মাথা ধরে তুষারের। ঘাড়ের একটা রগ টিকটিক করে নড়ে। অবসন্ন লাগে শরীর। সিগারেটে সিগারেটে বিস্বাদ, তেতো হয়ে যায় জিব। চেয়ার ছেড়ে উঠবার সময় প্রায়ই টের পায়, দুই পায়ে খিল ধরে আছে। চোখে একটা আঁশ–আঁশ ভাব।
অফিসের ছুটি হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। কেবল বেকাদায় আটকে থাকা তার ছোঁকরা স্টেনোগ্রাফারটি তাড়াতাড়ি তার কাগজপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। ঘর ঝাঁট দিচ্ছে জমাদার। চাবির গোছা হাতে দারোয়ান এঘর–ওঘর তালা দিচ্ছে।
দীর্ঘ জনশূন্য করিডোর বেয়ে তুষার হাঁটতে থাকে। নরম আলোয় সুন্দর করিডোেরটিকে তখন তার কলকাতার ভূগর্ভের ড্রেন বলে মনে হয়।
বাইরে সুবাতাস বইছে। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে এই প্রথম ফুসফুস ভরে বাতাস টানে সে! কোনও কোনও দিন এইখানে দাঁড়িয়েই ট্যাক্সি পেয়ে যায়। আবার কোনও কোনও দিন খানিকটা হাঁটতে হয়।
আজ ট্যাক্সি পেল না তুষার। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে তারপরে হাঁটতে লাগল।
একটা বিশাল বাড়ির কাঠামো উঠছে! দশ কি বারোতলা উঁচু লোহার খাঁচা। ইট কাঠ বালি আর নুড়ি পাথরের স্তূপ ছড়িয়ে আছে। নিস্তব্ধ হয়ে আছে কংক্রিট মিক্সার, ক্রেন হ্যামর উটের মতো গ্রীবা তুলে দাঁড়িয়ে। জায়গাটা প্রায় জনশূন্য। কুলিদের একটা বাচ্চা ছেলে পাথর কুড়িয়ে ক্রমান্বয়ে একটা লোহার বিমের গায়ে টং–টং করে ছুঁড়ে মারছে। ঘণ্টাধ্বনির মতো শব্দটা শোনে তুষার। শুনতে-শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে যায়।
ওই তুচ্ছ শব্দটি–ঘণ্টাধ্বনিপ্রতিম–তার মাথার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সে আবার ফিরে তাকায়। লোহার প্রকাণ্ড, ভয়ঙ্কর সেই কাঠামোর ভিতরে ভিতরে দিনশেষের অন্ধকার ঘনিয়ে উঠেছে। চারিদিক আকীর্ণ আবর্জনার মতো ইট কাঠ পাথরের স্তূপ! ঘণ্টাধ্বনিপ্রতিম শব্দটি সেই অন্ধকার কাঠামোর অন্ধকারে প্রতিধ্বনিত হয়ে ছুটে আসছে।
ওই শব্দ যেন কখনও শোনেনি তুষার। তার শরীরের অভ্যন্তরে অবদমিত কতগুলি অনুভুতি দ্রুত জেগে ওঠে। তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগে–ছুটি চাই, ছুটি চাই। মুক্তি দাও, অবসর দাও।
কীসের ছুটি! কেন অবসর! সে পরমুহূর্তেই অবাক হয়ে নিজেকে প্রশ্ন করে। কিন্তু উত্তর পায়। প্রতিদিন নিরবিচ্ছিন্ন কাজের মধ্যে ডুবে থাকা–এ তার ভালোই লাগে। ছুটি নিলে তার সময়। কাটে না। বেড়াতে গেলে তার অফিসের জন্য দুশ্চিন্তা হতে থাকে। কাজের মানুষদের যা হয়।
তবু সে বুঝতে পারে, তার মধ্যে এক তীব্র অনুভূতি তাকে বুঝিয়ে দেয়–কী রহস্যময় বন্ধন থেকে তার সমস্ত অস্তিত্ব মুক্তি চাইছে। ছুটি চাইছে। চাইছে অবসর। সে তন্ন–তন্ন করে নিজের ভিতরটা খুঁজতে থাকে। কিছুই খুঁজে পায় না। কিন্তু তীব্র অজানা ইচ্ছা এবং আকাঙ্ক্ষায় তার মন মুচড়ে ওঠে।
আবার সে পিছন ফিরে সেই লোহার কাঠামো দূর থেকে দেখে। সেখানে অন্ধকার জমে উঠেছে। একটা বাচ্চা ছেলে অদৃশ্যে এখনও পাথর ছুঁড়ে মারছে লোহার বিমের গায়ে।
চৌরঙ্গির ওপরে তুষার ট্যাক্সি পায়।
–কোথায় যাবেন?
ঠিক বুঝতে পারে না তুষার, কোথায় সে যেতে চায়। একটু ভাবে। তারপর দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলে–সোজা চলুন।
গাড়ি সোজা চলতে থাকে দক্ষিণের দিকে, যেদিকে তুষারের বাসা। সেদিকে যেতে তুষারের ইচ্ছে করে না। বাড়ি ফেরা–সেই একঘেয়ে বাড়ি ফেরার কোনও মানে হয় না।
সে ঝুঁকে ট্যাক্সিওয়ালাকে বলে–সামনের বাঁদিকের রাস্তা।
এলগিন রোড ধরে ট্যাক্সি ঘুরে যায়।
কোথায় যাব। কোথায়। তুষার তাড়াতাড়ি ভাবতে থাকে। ভাবতে-ভাবতে মোড়ে এসে যায়। এবার? ভিতরে সেই তীব্র ইচ্ছা এখনও কাজ করছে। অন্ধকারময় একটা বাড়ির কাঠামো লোহার বিমে নুড়ি ছুঁড়ে মারার শব্দ–তুষারের বুক ব্যথিয়ে ওঠে। মনে হয়–কেবলই মনে হয়–কী একটা সাধ তার পূরণ হয়নি। এক রহস্যময় অস্পষ্ট মুক্তি বিনা বৃথা চলে গেল জীবনে।
সে আবার বলে–বাঁয়ে চলুন।
ট্যাক্সি দক্ষিণ থেকে আবার উত্তর মুখে এগোতে থাকে। আবার সার্কুলার রোড। গাড়ি এগোয়। ভিতরে ভিতরে ছটফট করতে থাকে তুষার।
একটা বিশাল পুরোনো বাড়ি পেরিয়ে যাচ্ছিল গাড়ি। তুষার বাড়িটাকে দেখল। কী একটা মনে পড়ি পড়ি করেও পড়ল না। আবার বাড়িটা দেখল। হঠাৎ পাঁচ-সাত বছর আগেকার কয়েকটা দুরন্ত দিনের কথা মনে পড়ল। নিনি। নিনিই তো মেয়েটির নাম।
গাড়ি এগিয়ে গিয়েছিল, তুষার গাড়ি ঘোরাতে বলল ।
সেই বিশাল পুরোনো বাড়িটার তলায় এসে থামে গাড়ি।
.
হাতে সদ্য কেনা এক প্যাকেট দামি সিগারেট আর দেশলাই নিয়ে সেই পুরোনো বাড়ির তিন তলায় সিঁড়ি ভেঙে উঠতে-উঠতে তুষার ভাবে–এখনও নিনি আছে কি এখানে? আছে তো!
বাড়িটায় অসংখ্য ঘর আর ফ্ল্যাট। ঠিক ঘর খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তার ওপর পাঁচ-সাত বছর আগেকার সেই নিনি এখনও আছে কি না সন্দেহ। যদি না থেকে থাকে তবে ভুল করে ঢুকে বিপদে পড়বে না তো তুষার?
একটু দাঁড়িয়ে ভেবে, একটু ঘুরে–ফিরে দেখে তুষার ঘরটা চিনতে পারল। দরজা বন্ধ। বুক কাঁপছিল, তবু দরজায় টোকা দিল তুষার।
দরজা খুললে দেখা গেল, নিনিই। অবিকল সেইরকম আছে।
চিনতে পারল না, ভ্রূ তুলে ইংরিজিতে বলল –কাকে চাই?