কালও বড় ঝড়জল গেছে। ওই দক্ষিণধার থেকে ফৌজের মতো ঘোড়াসওয়ার ঝড় আসে। মাঠ কাঁপিয়ে। মেঘ দৌড়োয়, ডিমের মতো বড়-বড় ফোঁটা চটাসফটাস ফাটে চারধারে। আজ সকালে দশ ঝুড়ি পাকা জাম, গুটিদশেক কচি তাল কুড়িয়ে আনা হয়েছে খেত থেকে। ঘরের চালের খড় জায়গায়-জায়গায় ওলট-পালট। মাটির দেয়াল জল টেনে ডডাস হয়ে আছে, এখন চড়া রোদে শুকোচ্ছে সব। আমতলায় দাঁড়িয়ে মিছরি দেখে, ঋতীশ দাদা টিয়ার ঝাঁক উড়িয়ে দিল। ট্যাঁট্যাঁ ডাক ছেড়ে সবুজ পাখিরা উড়ে যাচ্ছে নদীর দিকে। মনে হয়, মানুষের ডানা নেই।
যারা এসেছে তারা সব কেমনধারা তোক যেন! রোগা-রোগা ভীতু-ভীতু চেহারা, পেটে সব খোঁদল-খোঁদল উপোসী ভাব। জুলজুল করে চারধারে চায় আর লজ্জায় আপনা থেকেই চোখ নামিয়ে নেয়। তাদের মধ্যে একজন আধবুড়ো লোক এসে উনুনটায় দুটো মোটা কাঠ ঢুকিয়ে দিল, ফুলঝুরির মতো ছিটকে পড়ল আগুনের ফুলকি। একটা কাঠ টেনে আধপোড়া একটা বিড়ি ধরিয়ে নিল লোকটা। এই গরমেও গায়ের ঘেমো তেলচিটে গেঞ্জিটা খুলছে না, বুকের পাঁজর দেখা যাবে বলে বোধহয় লজ্জা পাচ্ছে। তাকে দেখে হাসি পেল মিছরির।
সেই লোকটা চারধারে চেয়ে মিছরিকে দেখে কয়েক কদম বোকা পায়ে হেঁটে এসে বলল— আনাজপাতি কিছু পাওয়া যায় না?
খেত ভরতি আনাজ। অভাব কীসের? মিছরি বলল—এক্ষুনি এসে পড়বে। খেতে লোক নেমে গেছে আনাজ আনতে।
—একটু হলুদ লাগবে আর কয়েকটা শুকনো লঙ্কা। যদি হয় তো ফোড়নের জন্য একটু জিরে আর মেথি।
যদি হয়! যদি আবার হবে কী! খিচুড়ি রাঁধতে এসব তো লাগেই সে কি আর গেরস্তরা জানে না! মা সব কাঠের বারকোশে সাজিয়ে রেখেছে।
লোকটার দিকে চেয়ে মিছরি বলল—সব দেওয়া হচ্ছে। ডাল চালটা ধুয়ে আসুক।
লোকটা আকাশের দিকে একবার তাকাল। খুব সংকোচের গলায় বলল—বেলা হয়েছে।
সে কথার মধ্যে একটা খিদের গন্ধ লুকিয়ে আছে। শত চেষ্টা করেও লোকটা খিদের ভাবটা লুকোতে পারছে না। গেঞ্জিতে ঢাকা হলেও ওর পাঁজরা দেখা যায়। কারা এরা? কোত্থেকে এল, কোথাই বা যাচ্ছে? ছোটবোন চিনি যদিও মিছরির পিঠোপিঠি নয় তবু বোনে-বোনে ঠাট্টা ইয়ার্কির সম্পর্ক। ফ্ৰকপরা চিনি তিনটে ব্যাঙ লাফ দিয়ে মশলার বারকোশ নিয়ে এসে ঠক করে উনুনের সামনে রেখে ঝুপসি চুল কপাল থেকে সরিয়ে চেঁচিয়ে উঠল—এই যে মশলা দিয়ে গেলাম কিন্তু। দেখো সব নইলে চড়াই খেয়ে যাবে।
রোগা লোকটা তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে বারকোশটা নীচু হয়ে দেখল। বলল—উরেব্বাস, গরমমশলা ইস্তক। বাঃ, বাঃ, এ না হলে গেরস্ত! চিনি দুটো নাচুনি পাক খেয়ে মিছরির ধারে এসে জিভ ভ্যাঙাল, বলল—যা দিদি, তোর নামে উকিলের চিঠি এসেছে। বড্ড মোকদ্দমায় পড়ে গেছিস ভাই। চিঠিটা ভিজিয়ে একটু জল খাস শোওয়ার সময়, মিষ্টি লাগবে।
বলে নীচু ডালের একটা পাকা আম দুবার লাফ দিয়ে পেড়ে ফেলল চিনি। শিঙে দিয়ে চুষতে চুষতে যেদিকে মন চায় চলে গেল।
উকিলের চিঠি বলে সবাই খ্যাপায়। আর মোকদ্দমাও বটে। এমন মোকদ্দমায় কেউ কখনও পড়েনি বুঝি।
ধীর পায়ে লাজুক মুখে মিছরি ঘরে আসে। এমনিতে কোনও লাজলজ্জার বালাই নেই। বাপের বাড়িতে হেসে খেলে সময় যায়। কিন্তু ওই চিঠি যেদিন আসে সেদিন যত লজ্জা। বরের চিঠিই যেন বর হয়ে আসে।
মিছরির বর উকিল।
ছোটকাকা প্রায় সমানবয়সি। দাদা ঋতীশের চেয়েও ছ-মাসের ছোট। আগে তাকে নাম ধরেই শ্যামা’ বলে ডাকত মিছরি, নিজের বিয়ের সময় থেকে ‘ছোটকাকা’ বলে ডাকে।
ছোটকাকা মিছরির নাকের ডগায় দুবার নীলচে খামখানা নাচিয়ে ফের সরিয়ে নিয়ে বলল— রোজ যে আমার কাপড় কাচতে খিটখিট করিস, আর করবি?
অন্য সময় হলে মিছরি বলত করব, যাও যা খুশি করো গে।
এখন তা বলল না। একটু হেসে বলল—কাপড় কাচতে খিটখিট করব কেন, তোমার নস্যির রুমাল বাবু ও কাচতে বড় ঘেন্না হয়।
—ইঃ ঘেন্না! যা তাহলে, চিঠি খুলে পড়ে সবাইকে শোনাব।
—আচ্ছা, আচ্ছা, কাচব।
—আর কী কী করবি সব বল এই বেলা। বউদি রান্না করে মরে, তুই একেবারে এগোস না, পাড়া বেড়াস। আর হবে সেরকম?
–না।
—দুপুরে আমার নাক ডাকলে আর চিমটি কাটবি?
—মাইরি না।
—মনে থাকে যেন! বলে ছোটকাকা চিঠিটা কে বলল—এঃ, আবার সুগন্ধী মাখিয়েছে!
বলে কাকা চিঠিটা ফেলে দিল সামনে। পাখির মত উড়ে চিঠিটা তুলে নিয়ে মিছরি এক দৌড়ে বাগানে।
কত কষ্ট করে এতদূর মানুষ আসে, চিঠি আসে। রেলগাড়িতে ক্যানিং তারপর লঞ্চে গোসাবা, তারপর নৌকোয় বিজয়নগরের ঘাট, তারপর হাঁটাপথ। কত দূর যে! কত যে ভীষণ দূর!
খামের ওপর একধারে বেগনে কালিতে রবার স্ট্যাম্প মারা। কালি জেবড়ে গেছে, তবু পড়া যায়—ফ্রম বসন্ত মিদ্দার, বিএএলএলবি, অ্যাডভোকেট। আর বাংলায় মিছরির নাম-ঠিকানা লেখা অন্য ধারে। রবার স্ট্যাম্পের জায়গায় বুঝি এক ফোঁটা গোলাপগন্ধী আতর ফেলেছিল, সুবাস বুক ভরে নিয়ে বড় যত্নে, যেন ব্যথা না লাগে এমনভাবে খামের মুখ ছিড়ল মিছরি। এ সময়টায় তাড়াতাড়ি করতে নেই। অনেক সময় নিয়ে, নরম হাতে, নরম চোখে সব করতে হয়। মা ডাকছে—ও মিছরি, আনাজ তুলতে বেলা গেল। লোকগুলোকে তাড়া দে, বিপিনটা কি আবার গ্যাঁজা টানতে বসে নাকি দ্যাখ।
বড় বিরক্তি। লোকগুলোর সত্যি খিদে পেয়েছে। আকাশমুখো চেয়ে উঠোনে হাভাতের মতো বসে আছে সব। তাদের মধ্যে যারা একটু মাতব্বর তারা বাবুর সঙ্গে এক চাটাইতে বসে কথাবার্তা বলছে। রান্নার লোকটা বিশাল কড়া চাপিয়ে আধ সেরটাক তেল ঢেলে দিল।