বড় যন্ত্রণা হল সাঁটুর বুকটার মধ্যে। এক পুকুর জল উঠে আসতে চায় চোখে। মাথা নেড়ে বলে–না, না, লাগেনি। আমি চোর খুকুমণি, তাই আমার ছেলেপুলেরাও আমাকে ঘেন্না পায়। তুমি রোজ মেরো আমাকে। বুঝলে?
–এমন শাস্তি দেব তোমাকে রোজ সাঁটুদা, দেখবে ভয় পেয়ো না, আবার ষাট করে দেব।
ভিতর বাড়িতে দেশলাই নিয়ে ফের চেঁচামেচি হচ্ছে। হোক। সব দিকে কান দিলে হয় না। সাঁটুলালের অনেক কাজ। তাই উঠে গোয়ালঘরের দিকে গেল।
সন্ধের পর বাগানের রাস্তা থেকে বাবুর শোয়ানো চেয়ার আর জল বা চা রাখবার ছোট টুল তুলতে গিয়ে সাঁটুলাল সিগারেটের প্যাকেটটা পেয়ে গেল। তাতে দু-দুটো আস্ত সিগারেট। সাঁটু খুব অভিমানভরে ভাবল, নিলে লোকে বলবে চোর। কিন্তু এই যে হাতের নাগালে দুটো সিগারেট তার ভাগ্যে পড়ে আছে, এর মধ্যে কি ভগবানেরও ইচ্ছে নেই?
সাঁটু সিগারেটের প্যাকেটটা কামিনীঝোঁপের মধ্যে খুঁজে রেখে দিল। রাতে ভাত খাওয়ার পর জমবে ভালো।
রাতের কাজ সেরে সরস্বতী বিদেয় নিয়েছে। বিকেলে দেশলাই নিয়ে আজ আর বেশি চেঁচায়নি। মুখোমুখি দেখা হতে তেমন চোখে চোখে তাকায়ওনি লাল চোখ করে। বাবু আর বউদিও আজ তাড়াতাড়ি খেয়ে শুতে গেল।
বাইরের বারান্দায় শতরঞ্চি আর একটা কাঁথা পেতে শুয়ে সিগারেট টানছিল সাঁটুলাল। ঠিক সে সময়ে অন্ধকার কুঁড়ে সরস্বতী উঠে এসে বলল –আমি পোয়াতি–এ কথা কে বলল তোমায়?
সাঁটু শুয়ে-শুয়েই ঠ্যাং নাচাতে-নাচাতে বলে–আমার সঙ্গে থাকতে তিনবার হয়েছিলে, লক্ষণ সব চিনি কি না। বলবে আবার কে?
সরস্বতী উবু হয়ে বসে বলে–মিছে বলো না। শেফালি কুচ্ছো গেয়ে বেড়াচ্ছে। তার কাছেই শুনেছ। আচ্ছা পাজি মেয়েছেলে যা হোক। নিজের হবে না, অন্যের হলে শতেক দোষ খুঁজবে। এসব কথা জানাজানি হলে সুখকর্তা আর রাখবে ভেবেছ?
সাঁটুলাল মাথা চুলকোয়।
সরস্বতী আস্তে করে বলল –শোনো, তুমি সুখচন্দ্রকে বুঝিয়ে বলবে যে, তোমার সঙ্গে যখন থাকতুম তখনও আমার চরিত্রের দোষ ছিল না, এখনও নেই। বুঝলে? তোমার মুখের কথার দাম হবে। নইলে সুখচন্দ্র আজ রাতে ওই মাগির কাছে থাকতে গেছে, রাতভর এমন বিষ ঢালবে কানে যে, পুরুষটা বিগড়োবে। কালই গিয়ে সুখচন্দ্রের সঙ্গে বসে নানা কথার মধ্যে এক ফাঁকে কথাটা তুলো।
উদাসভাবে সাঁটুলাল বলে–তুলব’খন।
–তুলো! তুমি লোক খারাপ নয় আমি জানি। দুটো টাকা রাখো। বলে আঁচলের গেরো খুলে ভাঁজ–করা টাকা বের করতে যায় সরস্বতী।
ভারী লজ্জা পায় সাঁটুলাল। বলে–আরে থাক, থাক। ওসব রাখো।
–নাও। বিড়িটিড়ি খেও। মাসে দশ টাকা মাইনে পাও, তাতে কী হয়। রাখো এটা। আমি সদর ভেজিয়ে রেখে চলে এসেছি। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।
–হ্যাঁ, যাও। চারিদিকে ভারী চোর-ছ্যাঁচোড়।
–সে জানি। বলে সরস্বতী আঁধারে মিলিয়ে যায়।
সাঁটুলাল দু-নম্বর সিগারেটটা ধরিয়ে ফেলল। সরস্বতী বলে গেল, সে নাকি ভালো লোক। সত্যিই কি আর বলেছে! মন রাখা কথা। কিন্তু যদি সত্যিই তাকে ভালো লোক বলে জানত সবাই।
হাতের সিগারেটটার দিকে চেয়ে রইল সাঁটুলাল। ভারী রাগ হল নিজের ওপর। আচমকা সিগারেটটা প্রায় আস্ত অবস্থায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজের দু-গালে ঠাসঠাস করে কয়েকটা চড় দেয়।
রাগ তাতে কমে না। নিজের ঘাড় ধরে নিজেকে তোলে সে। তারপর নিজেকে নিয়ে ফটকের বার করে দিয়ে বলে–যা হারামজাদা আহাম্মক ছ্যাঁচড়া চোট্টা কোথাকার! ফের যদি আসিস তো জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দেব।
এই বলে হাত ঝেড়ে সাঁটুলাল ফিরে আসে। কালই গিয়ে সুখচন্দ্রকে বুঝিয়ে আসবে যে, সরস্বতী বড় সতী মেয়ে। তার গর্ভে সুখচন্দ্রেরই ছেলে। আর টাকা দুটোও ফেরত দেবে সরস্ব তাঁকে। সে ঘুষ–টুষ খাবে না আর। পুরোনো সাঁটুলাল বিদেয় নিয়েছে।
খুব আনন্দে খানিক ডগমগ হয়ে বসে রইল সাঁটুলাল। মনটা ভারী বড়সড় হয়ে গেছে। বুকে যেন হাওয়া–বাতাস খেলছে। প্রাণ জুড়িয়ে গেল।
কামিনীঝোঁপের নীচে পড়ে থাকা সিগারেটটা ধোঁয়াচ্ছে। এখনও অনেকটা রয়েছে। খামোকা পয়সা নষ্ট।
সাঁটুলাল গিয়ে সিগারেটটা তুলে আনল ফের। বসে-বসে মনের সুখে টানতে লাগল। দেশলাইটা নেড়ে দেখল অনেক কাঠি রয়েছে। বাঁ-ট্যাঁকে সরস্বতীর দেওয়া টাকাটা।
সাঁটুলাল ভাবল–এই শেষ পাপ–তাপ বাবা। কাল থেকে ভালো হয়ে যাচ্ছি।
উকিলের চিঠি
ও মিছরি, তোর নামে একটা উকিলের চিঠি এসেছে দেখগে যা। এই বলে মিছরির দাদা ঋতীশ টিয়ার ঝাঁক তাড়াতে খেতের মধ্যে নেমে গেল।
গোসাবা থেকে দুই নৌকো বোঝাই লোক এসেছে অসময়ে। লাট এলাকার ভিতর বাগে কোনও বিষয়কর্মে যাবে সব। এই অবেলায় তাদের জন্য খিচুড়ি চাপাতে বড় কাঠের উনুনটা ধরাতে বসেছিল মিছরি। কেঁপে উঠল। তার ভরন্ত যৌবন বয়স। মনটা সবসময়ে অন্য ধারে থাকে, শরীরটা এই এখানে। আজকাল শরীরটা ভার লাগে তার। মনে হয়, ডানা নেই মানুষের।
উকিলের চিঠি শুনে যে উনুন ফেলে দৌড়বে তার জো নেই। বাবা গুলিপাকানো চোখে দেখছে উঠোনের মাঝখানে চাটাইতে বসে। বড় অতিথিপরায়ণ লোক। মানুষজন এলে তার হাঁকডাকের সীমা থাকে না। তা ছাড়া দাদু, ঠাকুমা, মা, কাকা-জ্যাঠারা সব রয়েছে চারধারে। তাদের চোখ ভিতর বার সব দেখতে পায়। উটকো লোকেদের মধ্যে কিছু বিপ্রবর্ণের লোক রয়েছে, তারা অন্যদের হাতে খাবে না। সে একটা বাঁচোয়া, রান্নাটা করতে হবে না তাদের। চাল-ডাল ওরাই ধুয়ে নিচ্ছে পুকুরে। বাঁকে করে দু-বালতি জল নিয়ে গেছে কামলারা। উনুনটা ধাঁধিয়ে উঠতেই মিছরি সরে গিয়ে আমগাছতলায় দাঁড়াল।