ভাবাভাবির কী আছে তা সাঁটুলাল বোঝে না। দিনের মতো পরিষ্কার ব্যাপার। তবে কিনা সাঁটু এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। আসল ব্যাপার হল, সরস্বতীর আবার ছেলে হচ্ছে।
.
বাড়ি ঢুকতেই আগে বাবুর সঙ্গে দেখা। বাগানের রাস্তায় শোয়ানো চেয়ার পেতে বসে বই পড়ছে। কেবল বই পড়ে। শোনা যায় কলেজের খুব নামকরা মাস্টার। মেলা বিদ্যা জানে। যদিও ধান আর চিটের তফাত বুঝতে পারে না। তা সে যা হোক, বেশি বোঝেন না বলেই ভালো। বুঝলে বড় মুশকিল।
বাবু মুখ তুলে দেখে বললেন–সাঁটুলাল যে! কোথায় গিয়েছিলে?
–এই আজ্ঞে। কাল থেকে আর হবে না।
–সে জানি। কিন্তু বাড়ির সবাই ভাবছিল খুব।
–আর হবে না।
বাবু রোগা-রোগা লোক, বেশি কথা বলে না। শুধু গম্ভীর হয়ে বলল –বিশ্বাসী লোক পাওয়া বড় মুশকিল দেখছি।
ভিতর বাড়িটা থমথম করছে। বউদি এই সবে দুপুরের ঘুম থেকে উঠল। মুখ–টুখ ফুলে রাবণের মা। তার ওপর এলোকেশী ঠোঁটে শুকনো রক্তের মতো পানের রস। গলায় কপালে ঘাম। আঁচল কুড়োতে–কুড়োতে কুয়োতলায় যাচ্ছিল, ভিতরের বারান্দায় তাকে দেখে থমকে গিয়ে বলল –তুমি কার হুকুমে বাড়িতে ঢুকেছ? বেরোও এক্ষুনি।
সাঁটুলাল টপ করে কান ধরে ফেলে বলল –কাল থেকে আর হবে না।
ঘুম থেকে উঠলে মানুষের তখন–তখন আর তেমন তেজ থাকে না। বউদিরও রাজ্যের আলিস্যি। হাই তুলে বলল –পয়সাটা ফেরত দেবে তো?
–মাইনে থেকে কাটান দিয়ে দিব বরং।
–চায়ের জল চড়াও গে যাও। বলে বউদি কুয়োর দিকে গেল।
চায়ের জল চড়ানোর কথা সাঁটুলালের নয়। সে বাইরের কাজের লোক। জল তোলে, গরুর দেখাশোনা করে, দুধ দোয়ায়, বাগান করে, কাপড় কাঁচে আর ফাইফরমাশ খাটে। ঘরের কাজ সরস্বতীর ওপর। রান্না বাসন মাজা, ঘর ঝাঁটানো বা মোছা। তাই চায়ের জল করার কথায় অবাক মানে সাঁটুলাল।
কাজ তেমন জানা নেই। তবু পায়ে-পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগোল। রান্নাঘরের দরজা জুড়ে মেঝেয় আঁচল পেতে সরস্বতী শোওয়া। অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
আহা, ঘুমোক। আবার মা হবে। এ সময়টায় শরীর এলিয়ে যায়। সরস্বতীর হাঁ মুখের কাছে মাছি উড়ছে, বসছে। হাত নেড়ে তাড়াল সাঁটুলাল।
তারপর খুব সাবধানে সরস্ব তাঁকে ডিঙিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে সে। কেরোসিনের স্টোভকে জুত করতে পারছিল না। খুটুরমুটুর করে নাড়ছিল। শব্দ পেয়ে সরস্বতী পাশ ফিরে রক্তচোখে চেয়ে বলল –ও কী! রান্নাঘরে ধুলোপায়ে ঢুকেছ যে বড়! বাইরের জামাকাপড় নিয়ে ছিষ্টি ছুঁচ্ছো! তুমি কি মানুষ? সাতবাসি হেগো মোতা কাপড়। তার ওপর কোথায় কোন আস্তাকুঁড়ে রাত কাটিয়েছ! বেরোও!
সাঁটুলাল সরস্বতীর মুখপানে চেয়ে খুব হাসে। বেশ লাগছে দেখতে। মা হওয়ার চেহারাই আলাদা।
সরস্বতী উঠে বসতে-বসতে বলল –চৌকাঠ পেরোলে কেমন করে বলো তো। আমাকে ডিঙোলে নাকি?
–তা কী করব!
কী করব মানে? জলজ্যান্ত মানুষকে ডিঙোতে হয়?
সাঁটুলাল খুব গম্ভীর মুখ করে বলল –পোয়াতি মানুষ যেখানে সেখানে শুয়ে থাকো কেন? এ সময়টায় অসাবধান হওয়া ভালোনা।
কে জানে কেন, এ কথায় সরস্বতীর মুখে বন্ধন পড়ে গেল। আর একটাও কথা না বলে উঠে চলে গেল বোধহয় কুয়োতলায়। একটু বাদে ভেজা মুখচোখ নিয়ে ফিরে এসে বলল –সরো, আমি চা করছি।
সাঁটুলাল সরল বটে, কিন্তু গেল না। দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে চেয়ে রইল সরস্বতীর দিকে। সরস্বতী টের পাচ্ছে তবু চোখ তুলে তাকাচ্ছে না।
সরস্বতী তাকাচ্ছে না বলে যে সাঁটুকে খাতির দেখাচ্ছে তা নয়। আসলে এই পোড়ামুখখানা দেখাতে তার ইচ্ছেই করে না।
স্টোভের সলতে কমে গিয়েছিল। টিনের চোঙাগুলো খুলে সরস্বতী সলতে টেনে বড় করে দেশলাই জ্বেলে সলতে ধরাল। কেটলি চাপিয়ে কেরোসিনের হাত ধুতে গেল উঠোনবাগে। দেশলাইটা পড়ে রইল মেঝেয়।
সাঁটুলালের দেশলাই ফুরিয়েছে। সেই আধখানা কাঠি দিয়ে কখন একটা বিড়ি খেয়েছে। ভাবাভাবির বড় ঝামেলা। দেশলাইটা তুলে নিয়ে সাঁটু সরে পড়ল। রাজ্যের কাজ পড়ে আছে। জল তুলতে হবে, গরুর জাবনা দিতে হবে, গোয়ালে ধোঁয়া। তার আগে আবডালে কোথাও বসে ভরপেট বিড়ি খাবে এখন।
তেঁতুলের ঠান্ডা ছায়ায় বসে সাঁটুলাল পশ্চিম আকাশে রঙের বাহার দেখছিল। বিড়ি খেলে মাথাটা খুলে যায়। সব ভালো লাগে কিছুক্ষণ। তাড়ি খেলে আরও খোলে। গাঁজা খেলে তো স্বর্গরাজ্য হয়ে যায় দুনিয়াটা।
বিড়িটা যখন শেষ হয়ে এসেছে তখন বাবুর ছ’বছরের মেয়ে বাবলি এসে পিছন থেকে গলা। জড়িয়ে ধরল–সাঁটুদা, তুমি পয়সা চুরি করে পালিয়েছিলে?
সাঁটু একগাল হেসে বলে–না। মাইরি না।
–আমি জানি। তুমি পয়সা চুরি করে কাল চলে গিয়েছিলে। কান ধরো।
সাঁটু কান ধরে জিভ কেটে বলে, ছিছি। বড় অন্যায় হয়ে গেছে। কাল থেকে আর বলব না।
রোজ নতুন-নতুন সব ব্যাপার শিখেছে বাবলি। আজকাল ইস্কুলে যায়। ইস্কুল থেকে কত কী শিখে আসে। যেমন এখন বাবলি একটা শুকনো গাছের ডাল কুড়িয়ে এনে বলে হাত পাত।
সাঁটু হাত পাতে। বাবলি দুর্বল হাতে গাছের ডালটা দিয়ে সাঁটুর হাতে মারে। বলে, আর করবে?
–না গো।
–নীলডাউন হও।
সাঁটু নীলডাউন হয়।
আর কী করবে ভেবে না পেয়ে বাবলি–আচ্ছা, হয়েছে। মেরেছি তো! শাস্তি দিয়েছি তো! এসো, এবার আদর করি।
বলে কাছে এসে বাবলি সাঁটুর মাথাটা নিজের কাঁধে চেপে ধরে চুলে হাত বুলিয়ে বলে–যাট, ষাট, ষাট। লেগেছে সাঁটুদা?