সরস্বতী অবশ্য বাবুর বউকে ভয় খায় না। উলটে তেজ দেখায়। কিন্তু সেদিন আর বাড়াবাড়ি করেনি। শুধু শাসিয়ে রেখেছিল আটাচক্কির বিশেকে দিয়ে মার খাওয়াবে। সেদিনই সন্ধের মুখে বিশে সাঁটুকে ধরে দোকানঘরের পেছনে আবডালে টেনে নিয়ে দিলও ঘা কতক। আরও দিত, সুখচন্দ্র সাড়াশব্দে এসে পড়ে বলল –যাক গে, বারো আনা তো মোটে পয়সা! কিন্তু সুখচন্দ্র মাপ করে তো সরস্বতী করে না। সে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল –মুখ দিয়ে রক্ত বেরোবার পর ছাড়া পাবে। সাঁটুলাল সরস্বতীর পা ধরতে উবু হয়ে বলে বলল –কাল থেকে হবে না।
সাঁটুলাল নিজেকে আজও জিগ্যেস করে–পয়সাটা কি সত্যিই মেরেছিল সাঁটু। সাঁটু শিউরে উঠে বলে–মাইরি না। মা কালীর পা ছুঁয়ে বলতে পারি। শালার পয়সাগুলোই ফক্কড়, বুঝলে! আমাকে জব্দ করতে কোন ফাঁকে সুট করে চলে এল হাতে।
এইসব দুঃখের কথা সাঁটুলাল কাউকে বলতে চায়। উজাড় করে বলবে সব। কিন্তু সাধুটা
সটকেছে। আছেই বা কে?
গতকাল সাঁঝের মুখে বাবুর বউ নদীয়াল মাছ কিনতে পয়সা দিয়ে পইপই করে বলেছিল–দেখো সাঁটু, পয়সার হিসেব দিও। সরে পোড়োনা।
সাঁটুলাল মনে-মনে দিব্যি কেটেছিল–আর নয়। এবার মানুষ হতে হবে। পাঁচজনের কাছে দেখানোর মতো মুখ চাই।
পয়সাটা ফেরত দিত সাঁটু যদি নিজে সে ফিরত। হল কি গ্রহের ফের। বাজারে গিয়ে দেখল নদীয়াল মাছ ওঠেনি। কয়েকটা ন্যাটাং চ্যাং মাছ উঠেছে যা বাবুরা খায় না। পয়সা নিয়ে ফিরেই আসছিল। তেমনি সময়টায় হরগোবিন্দ খবর দিল খাডুবেড়েয় যাত্রা হচ্ছে। যাবে নাকি সাঁটুলাল? আগুপিছু ভাবনা সাঁটুলালের কোনও কালেই ছিল না। চাঁদনি রাত ছিল। ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছিল। বাবুর বাড়িমুখো হতে আর ইচ্ছে হল না তার। মনে-মনে ভাবল–আজকের রাতটাই শেষ পাপ তাপ করে নিই। কাল থেকে মাইরি–কাল থেকে ভালো হয়ে যাবে একেবারে। এই ভেবে তাড়ি খেয়ে নিল প্রাণভরে। তারপর খাড়ুবেড়ের রাস্তা ধরল।
আজ তাই ফিরতে একটু লজ্জা–লজ্জা করছে তার। সরাসরি গিয়ে ঢুকে পড়লে বাবুর বউ বড় চেঁচামেচি করবে।
সাঁটুলাল তাই বাজারের দিকে আটাচক্কির দোকানে গিয়ে উঠে বলল কী খবর হে সুখচন্দ্র? ভালো তো?
সুখচন্দ্র বেশ মানুষ। মুখে একটা নির্বিকার ভাব। ঝড় হোক, ভূমিকম্প হোক সুখচন্দ্রের মুখে কোনও শুকনো ভাব নেই। বলল –ভালো আর কই? কাল থেকে নাকি তুমি হাওয়া। বাবুর বাড়িতে খুব চেঁচামেচি হচ্ছে, যাও।
যাচ্ছি। বলে সাঁটুলাল বেঞ্চিতে বসে পড়ে। বিশে চাক্কি চালাচ্ছিল। আটা উড়ছে ধুলোর মতো চারদিকে। হুড়ো দিয়ে বলল যাও যাও। কাজের সময় বসতে হবে না।
সাঁটুলাল দাঁত খেচিয়ে বলে–তুমি কে হে। যার দোকান সে কিছু বলে না তোমার অত ফোপরদালালি কীসের?
লেগে যেত। কিন্তু এ সময়ে সাঁটুর ছেলে বিষ্ণু রাস্তা থেকে উঠে এসে সুখচন্দ্রকে বলল বাবা, মা বলে দিল ফেরার সময় আনাজ নিয়ে যেতে।
সাঁটু প্রাণভরে দেখছিল। তার ছেলে। হ্যাঁ তারই ছেলে। সুখচন্দ্রকে ‘বাবা’ ডাকছে! আহা ডাকুক। ওর ‘বাবা’ ডাকার মতো লোক চাই তো। সে নিজে তো আর মানুষ নয়।
ছেলে বেরোল তো পিছু–পিছু সাঁটুলালও বেরোয়। ছেলে কয়েক কদম হেঁটেই পিছু ফিরে বলে –তুমি আসছ কেন?
সাঁটু একটু রেগে বলে–কেন, তোর বাবার রাস্তা?
–তুমি অন্য বাগে যাও। নইলে মাকে বলে দেব।
–কী বলবি?
–তুমি কুন্তির পয়সা চুরি করেছিলে না? মনে নেই?
–ওঃ চুরি! গঙ্গা-যমুনা খেলতে গিয়ে খুঁড়ি কোথায় পয়সা হারিয়ে আমার ঘাড়ে চাপান দিলে।
–সে যাই হোক, তুমি কাছে আসবে না আমাদের।
–বাপকে কি ভুলে গেলি বুঝি?
ছেলে চলে গেল।
পালপাড়ার পুকুরধারে শেফালি ধরল তাকে। গা ধুয়ে ঘরে ফিরছে। দেখতে পেয়ে বলে–তোমার সঙ্গে কথা আছে।
শেফালি মোটা মানুষ। শরীর ঢিলেঢালা হয়ে গেছে। ঘামাচিতে গা কাঁথার মতো হয়ে আছে। গোলপানা থোম্বা মুখখানা দেখলে কাতলা মাছের মাথার মতো মনে পড়ে। দাঁতে নস্যি দেওয়ার নেশা আছে। একগাল হেসে বলল –খবর শুনেছ নাকি? তোমার যে আবার ছেলে হবে।
ছেলে কি বাতাসে হয়! সাঁটু অবাক হয়ে বলে–আমার ছেলে হবে কী গো!
–ওই হল! তোমার বউয়ের।
সাঁটু লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলে–কী যে বলো বউঠান!
–বলছি বাপু, শুনে রাখো! তবে এও বলি, সরস্বতীর পেটেরটা যদি তোমার ছেলে না হয় তবে সে তোমাদের সুখবাবুর ছেলেও নয়।
সরস্বতীর ছেলে হবে শুনে সাঁটুলাল খুশিই হল। আহা! হোক, হোক। ছেলেপুলে বড় ভালোবাসে সরস্বতী। ছেলেপুলে নিয়ে সব ভুলে থাকে।
খুশি মনে সাঁটুলাল বলল –ভালো, ভালো।
ভালো কী! অ্যাঁ! ভালোটা কী দেখলে? পাঁচজনে যাই বলুক, আমি তো সুখবাবুর মুরোদ জানি। ছেলের জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা সে মেনিমুখোর নেই। থাকলে আমার বাঁজা বদনাম ঘুচত। তুমি বুঝি ভেবেছ সুখবাবুর ক্ষমতায় কাণ্ডটা হচ্ছে? আচ্ছা দিনকানা লোক তোমরা। এ সুখবাবুর কাজ নয় গো। সাঁট আছে।
কীসের সাঁট?
থোম্বা মুখে ঢলাঢলি হাসি খেলিয়ে শেফালি বলে–দেখেও দ্যাখো না নাকি? বিশে যে তোমাকে সেদিন খুব ঠেঙাল সে কেন জানো? বিশেকে যে দীনবন্ধুবাবু তার কারবারে বেশি মাইনেয় লাগাতে চেয়েছিল তাতে বিশে গেল না কেন জানো? সে যে এখানে বিশ টাকা মাইনে আর দুবেলা খোরাকি পেয়ে আঠার মতো কেন লেগে আছে জানো? বোঝো না? বিশে আর সরস্বতীর ভাবসাব দেখেও বোঝো না? চোখ–কান খোলা রেখে চলবে। তাহলে আর পাঁচজনের কাছে শুনে বুঝতে হবে না। যাও, বাড়ি গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাব।