শেষ লাইনটা ‘রাবণ বধ’ যাত্রা থেকে নেওয়া। নিত্যচরণ শ্বাস ফেলে পোস্টকার্ডটা আবার পকেটে ঢোকায়। বিড়ি নিবে গেছে। আবার ধরিয়ে নিল নিত্যচরণ।
সাঁটুলাল নিত্যচরণের মুখের ভাব দেখছিল একমনে। মোটে মাইলখানেক রাস্তা। দেখি না দেখি না বলে কাটিয়ে দেবে। চিঠিটা আর-একটু যদি লম্বা হত! লোকে যে কেন লম্বা-লম্বা চিঠি লেখে না তা বোঝে না সাঁটুলাল।
নিত্যচরণ অবশ্য পয়সা আদায় করল না শেষপর্যন্ত। নামবার সময় শুধু বলল –এই চারশো বিশ, বাস কি জল দিয়ে চালাই আমরা? তেল কিনতে পয়সা লাগে না!
বাস তেলে চলে না জলে চলে তা জেনে সাঁটুর হবেটা কী? সে নিজে যে কীসে চলে সেইটাই এক ধাঁধা। চলেও গেল এই বছর পঞ্চাশেক বয়স পর্যন্ত।
পথটা খুব পার হওয়া গেছে। চোত মাসের রোদে এ-পথটুকু কমতি হল সে একটা উপরি লাভ।
সুখচন্দ্রের সঙ্গে আগে–আগে কথা বলত না সাঁটুলাল। এখন বলে। ভেবে দেখেছে, সুখচন্দ্রের দোষ কী? সরস্ব তাঁকে তো সে নিজে এসে ভাগায়নি। সরস্বতী নিজে থেকেই ভেগে গেল। বরং অন্য কারও চেয়ে সুখচন্দ্রের সঙ্গে আছে সে বরং ভালো। লোকটা কাউকে বড় একটা দুঃখ দেয় না। ফুর্তিবাজ লোক। যা আয় করে তা খেয়ে পরে ওড়ায়। বাজারের সেরা জিনিসটা আনবে। মরশুমের আমটা কাঁঠালটা বেশি দাম দিয়ে হলেও কিনবে, ঘরে তার রেডিও পর্যন্ত আছে। আগের পক্ষে বাঁজা বউ শেফালিকেও খারাপ রাখেনি। নিজের বাড়ি শেফালিকে ছেড়ে দিয়ে অন্য পাড়ায় সরস্বতীর জন্য আলাদা ঘর তুলেছে। দুই বাড়িতেই যাতায়াত।
অনেক ভেবেচিন্তে সাঁটুলাল দেখেছে, ব্যাপারটা খারাপ হয়নি। প্রথম প্রথম তার অভিমান হত বটে। কিন্তু এও তো ঠিক যে তিন–তিনটে বাচ্চা সমেত সরস্বতী তার ঘাড়ে গন্ধমাদনের মতো চেপেছিল এতদিন। এই যে সে গত রাতে খাড়ুবেড়েতে যাত্রা শুনতে গিয়ে রাত ভোর করে। তারপর বেলাভর ঘুমিয়ে নাড়ুগোপালের মতো হেলতে–দুলতে তিন প্রহর পার করে ফিরছে, সরস্বতী থাকলে হতে পারত এমনটা? মাগি গিয়ে এখন তার ঝাড়া হাত-পা। ওদিকে ছেলেপুলেগুলো দু-বেলা খেতে পায়, পরতে পায়। সরস্বতীর চেহারা আদতে কেমন তা সাঁটুলালের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পাঁচ-সাত বছর পর থেকে কেউ বুঝতে পারত না। এখন সরস্বতী পুরোনো খোলস ছেড়ে নতুন চামড়া নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। হাতপায়ের গোছ হয়েছে খুব। গায়ে রস হয়েছে। চোখে ঝলক খেলে। বেশ আছে।
গোঁজ মুখ করে ঘুরে বেড়াত সাঁটুলাল, একদিন সুখচন্দ্ৰ ডেকে বলল –সাঁটুভায়া, ভগবান আমার মধ্যেও আছে, তোমার মধ্যেও আছে। তুমি আমি কি আলাদা? সরস্বতী এসে জুটল, ফেলি কী করে বলো?
এমনি দু-চার কথা হতে-হতে সাঁটুলাল ভাব করে ফেলল। তবে সরস্বতীর পুরোনো সব রাগ যায়নি। সুখচন্দ্র যতই মিতালি করুক সরস্বতী এখনও দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয় আর আকাশ বাতাসকে শুনিয়ে তার কেচ্ছা গায়।
গাওয়ার মতো কেচ্ছা কিছু কম নেই সাঁটুলালের। তার সারাটা জীবন চুরি ছ্যাঁচড়ামি আর ছিনতাইয়ের কাণ্ডে ভরা। সেসব পুরোনো কথা। গত সপ্তাহে পালপাড়ার কদমতলায় সাঁটু নিজের মেয়ে কুন্তিকে গঙ্গা–যমুনা খেলতে দেখে মায়ায় পড়ে দাঁড়িয়ে গেল। শত হলেও সন্তান। মেয়েটাও খানিক খেলা করে বাপের কাছে এল দৌড়ে। একগাল মিষ্টি হেসে ডাকল বাবা! বুক জুড়িয়ে যায়। মেয়েটার খালি গা, পরনে শুধু একটা বাহারি রঙচঙে ইজের।
সাঁটুর চোখটাই পাপে ভরা। যেখানে যত লোভানি আছে সেখানে তার পাপ নজর পড়বেই কি পড়বে। মেয়েটাকে দেখতে গিয়ে প্রথমেই তার নজর পড়ল মেয়ের কোমরের কাছে ইজেরের কষি এক জায়গায় একটু উলটো ভাঁজ হয়ে আছে। আর সেই ভাঁজে স্পষ্ট একটা আধুলি আর কয়েকটা খুচরো পয়সার চেহারা মালুম হচ্ছে।
মেয়েকে জড়িয়ে ধরে খানিক আদর করছিল সাঁটু। তারপর মেয়ে ফের গঙ্গা–যমুনার কোটে ফিরে গেল, সাঁটু গেল বাজারে বাবুর জন্যে সিগারেট আনতে। আর যেতে-যেতেই টের পেল, কখন যেন তার হাতে একটা আধুলি দুটো দশ পয়সা আর-একটা পাঁচ পয়সা চলে এসেছে। মাইরি! মা কালীর দিব্যি! সে টেরও পায়নি কখন আপনা থেকে পয়সাগুলো এসে গেল। একেবারে আপনা থেকে।
এসে যখন গেলই তখন তাকে ভগবানের দেওয়া পয়সা মনে করে সাঁটুলাল তৎক্ষণাৎ নগদানগদি তাড়ি খেয়ে ফিরল। বাবুর বাড়ির ফটকে তৈরি হয়েই দাঁড়িয়েছিল সরস্বতী আর তার গা ঘেঁষে কুন্তি। আর যাবে কোথায়! প্রথমে মেয়েটাই দেখতে পেয়ে চেঁচাল–মা! মা! ওই যে আসছে। সঙ্গে-সঙ্গে সরস্বতী ঠিক কলেরগানের পুরোনো বয়ান ছেড়ে যেতে লাগল–বাপের ঠিক নেই, নষ্ট মাগির পুত, কেলেকুত্তার পায়খানা। ডোমে ঠ্যাঙে দড়ি বেঁধে তোকে টেনে ভাগাড়ে ফেলবে। নিব্বংশের ব্যাটা, মেয়েকে পয়সা দিয়ে ডাল আনতে পাঠিয়েছি–আর মেয়েরও বলিহারি বাবা কোন আকেলে তুই ওই গরুচোরের ব্যাটাকে সোহাগ দেখাতে গেলি! গেল তো ঘাটের মড়ার আক্কেল দ্যাখ! মেয়ের ইজেরের কষি থেকে পয়সা মেরে দিল। বলি ও ঢ্যামনা, পয়সার জন্য তুই না পারিস কী বল দেখি!
বলত আরও। বাবুর বউ বেরিয়ে এসে চোখা গলায় বলল –দ্যাখ সরস্বতী, ছোটলোকের মতো চেঁচাবে তো দূর হয়ে যাও। সাঁটু, তুমিও এক্ষুনি বিদেয় হও। একটা চোর, আর-একটার মুখ আস্তাকুঁড়। আমার বাচ্চাটা এসব শুনে আর দেখে শিখবে। যাও, যাও।