রজনি হঠাৎ উঠে তাঁবুর দিকে হাঁটতে লাগল, ঢোলাকিয়া ভাবল সে কোনো মারাত্মক ভুল করে বসল নাকি? তবে বুদ্ধি করে সে ডান হাতের গ্রিপ বাঁ-হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। এবং শুধু গ্রিপ ছাড়াও অনেক ব্যাপার আছে যা, নকল করা সহজ নয়, বিশেষ এক গতিতে, বিশেষ এক কোণ থেকে ডায়াগোনাল রান আপ নিয়ে আসতে হবে। ডেলিভারির সময়ে গোটা হাতেরও একটা বিশেষ কম্পন চাই, এসব সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয় অনুধাবন ও অনুশীলন সোজা কথা নয়। তবু মনটার খুঁতখুঁতুনি থেকেই গেল।
রামনাথ তাকে আরও বল করার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল, কিন্তু অরুণ রাজি হল না, টেলিফোনে একটা হেলি-ট্যাক্সি ডাকিয়ে এনে বাড়ি ফিরল।
একটু রাতের দিকে ফোনটা এল।
আমি রজনি।
ওঃ, রামনাথবাবুর ছোট্ট মেয়েটা?
হ্যাঁ। আপনি আজ খুব ভুল করেছেন, বলের ওপর আমি লিখে রেখেছিলাম ডোন্ট।
হ্যাঁ, দেখেছি।
তা সত্ত্বেও শেষ বলটা ওরকম করলেন কেন?
না-করলে, তোমার বাবা হতাশ হতেন।
তাহলেও ক্ষতি ছিল না, আজ মাঠের চারপাশে লোক ছিল, আপনি তাদের দেখেননি, কিন্তু আমি জানি, দক্ষিণ আফ্রিকার বিশেষজ্ঞরা আপনার অ্যাকশনের ছবি তুলে নিয়ে গেছে। আপনি আমার বারণ শুনলেন না কেন?
আমার ভুল হয়েছে। আসলে তুমি একটি বাচ্চা মেয়ে বলে, তোমার বারণকে বেশি গুরুত্ব দিইনি।
আমার বয়স চোদ্দো, আজকাল এ-বয়সের ছেলেমেয়েরা যথেষ্ট বুদ্ধি রাখে।
কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার বিশেষজ্ঞরা জানল কী করে?
আমার বাবাই জানিয়েছে। চল্লিশ বছর আগে বাবাকে ভারতীয় টিম থেকে অন্যায়ভাবে বাদ দেওয়া হয়। এটা তারই প্রতিশোধ।
কিন্তু উনিই তো আমাকে এ-কাজে নামিয়েছিলেন।
হ্যাঁ, কারণ তিনি জানেন, আপনার মতো একজন ধুরন্ধর অঙ্কবিদকে দিয়েই কাজটা সম্ভব। আমার বাবাও একজন ম্যাথমেটিশিয়ান, কৌশলটা আপনাকে দিয়ে আবিষ্কার করিয়ে, সেটা অন্য দেশকে বেচে দেওয়ার মতলব ছিল তাঁর।
এখন তাহলে কী হবে?
সেটা আপনিই ঠিক করুন। আর এক মাস পরেই বিশ্বকাপ। দু-হাজার নিরানব্বই সালের সতেরোই ডিসেম্বর। প্রথম ম্যাচেই ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষিণ আফ্রিকা, আপনি কতবড়ো ভুল করেছেন আজ তা বুঝতে পারছেন?
পারছি রজনি, আমার এতদিনের পরিশ্রম বৃথা গেলে আমি খুবই ভেঙে পড়ব।
এখন মন দিয়ে শুনুন।
বলো।
আপনি আমার বারণ শুনবেন না বলে ধরে নিয়ে, আমি একটা কাজ করেছি। কী কাজ? পিচের সোজাসুজি যে দুটি বাতিস্তম্ভ ছিল, আমরা সে দুটি থেকে বিমার রশ্মি ফেলেছিলাম। যতদূর জানি এই রশ্মি ফেললে ক্যামেরার চোখ ঝলসে যায়, মানুষের চোখে কিছু ধরা পড়ে না।
সত্যি?
হ্যাঁ, আমি এবং আমার বান্ধবীরা বুদ্ধি করে এইটে করেছি। তাতে কতদূর কাজ হবে, তা আমরা জানি না। ওদের কাছে হয়তো আরও অত্যাধুনিক ক্যামেরা আছে।
সেটা থাকাই সম্ভব।
আমি যে-বলটা আপনাকে দিয়েছিলাম তাতেও একটা সলিউশন মাখানো ছিল। তাতে মুভমেন্টের সময় হাওয়া লাগলে, সেলাইগুলো সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যাবে। জানি না, এতে কতটা কাজ হবে। কিন্তু আমরা। আমাদের সাধ্যমতো করেছি।
তোমাকে কী বলে ধন্যবাদ দেব?
বিশ্বকাপটা জিতুন, তাহলেই হবে।
.
বিশ্বকাপের শুরুতেই সারাপৃথিবীতে তুমুল আলোচনা, ভারত তাদের দলে একজন নন-ক্রিকেটার অঙ্কবিদকে খেলাচ্ছে। হাসাহাসি, ঠাট্টা, মশকরা, সমালোচনা, প্রতিবাদ সবই হতে লাগল। তার মধ্যেই কলকাতার ইডেন উদ্যানে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে খেলতে নামল ভারত। টসে জিতে ভারতের অধিনায়ক নানক দাশগুপ্ত প্রতিপক্ষকে ব্যাট করতে পাঠাল ঢোলাকিয়ার পরামর্শে।
প্রথম ওভারেই ঢোলাকিয়ার হাতে বল। সারামাঠ নিশ্চপ। একজন অঙ্কের অধ্যাপক অ-ক্রিকেটার কী করতে পারে জানার জন্য সমস্ত পৃথিবীই দমবন্ধ করে বসে আছে। অরুণ ঢোলাকিয়া কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইল। তারপর শুরু করল দৌড়।
প্রথম বলটা লুপ। স্টাম্পের সোজা পিচে পড়ে, বাঁ-দিকে বেঁকে গেল, ব্যাটসম্যানের বাড়ানো ব্যাটকে এড়িয়ে, ফের ডানদিকে ঘুরল, না, স্টাম্পে লাগল না। একটু উঁচু দিয়ে চলে গেল উইকেটকিপারের হাতে। ঢোলাকিয়া বিরক্ত। ক্যালকুলেশনের সামান্য ভুল।
দ্বিতীয় বলটা আবার লুপ। কিন্তু ধীর গতির ব্যাটসম্যান মরিস বলটাকে তার সিনথেটিক ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে দিল কভারে, চার।
আজকাল মাঠে কোনো আম্পায়ার থাকে না। কিন্তু মাঠের চারদিকে অজস্র বৈদ্যুতিন চোখ। স্কোরবোর্ড নির্দেশ দিল চারের।
তৃতীয় বলটা করার আগে ফের একটু ধ্যানস্থ হল সে। ধীরে দৌড়ে এসে বল করল। মরিস ব্যাটটা তুলল কিন্তু সময়মতো নামাতে পারল না। মাটি কামড়ে বলটা গিয়ে তার মিডলস্টাম্প উপড়ে দিল, শুটার।
ওভার যখন শেষ হল, তখন স্কোরবোর্ড-এ চার রানে চার উইকেট। হ্যাট্রিকসহ। দলের অন্য খেলোয়াড়রা এতদিন অ-ক্রিকেটার ঢোলাকিয়াকে পাত্তা দিচ্ছিল না। কিন্তু ওভার শেষ হলে, কেউ কেউ এসে তার পিঠ চাপড়ে গেল।
খেলা অবশ্য বেশিক্ষণ গড়াল না। মোট বাইশ রানে প্রতিপক্ষ অল আউট। ঢোলাকিয়ার ঝুলিতে দশ ইউকেট। সতীর্থদের কাঁধে চড়ে প্যাভিলিয়নে ফিরল ঢোলাকিয়া।
দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুতেই প্রবল ঝড়বৃষ্টি এসে গেল। তাতে অবশ্য খেলা আটকায় না আজকাল। দুশো মিটার ওপরে অন্যদিক থেকে দশটা পদ্মফুলের পাপড়ির মতো স্বচ্ছ ঢাকনা এসে গোটা মাঠ ঢাকা দিয়ে দিল।