ঢোলাকিয়া মাথা নেড়ে বলল, দেখলাম, আপনি চল্লিশ বছর আগে শুটারস দিতেন।
হ্যাঁ, সারা পৃথিবীতে আমিই একমাত্র শুটারস আর লপ বল করতে পারতাম। তবে ছ-টা বলের মধ্যে একটা দুটো বা তারও কম। ডেলিভারির ওপর কন্ট্রোল সহজে আসে না। কঠোর অনুশীলন দরকার, কেরিয়ারের শেষদিকে আমি কৌশলটা খানিক রপ্ত করতে পেরেছিলাম, কিন্তু পুরোটা নয়। আজ অবধি কৌশলটা কাউকে শেখাইনি।
ঢোলাকিয়া কিছুক্ষণ নিঃশব্দে খাবার খেয়ে গেল, তারপর বলল, কাল ওরা আমার পরীক্ষা নেবে।
লোকটা একটু হাসল, মুখ না তুলেই বলল, ঈশ্বর তোমার সহায় হোন। যদি ওরা তোমাকে টিমে নেয়, তাহলে এই প্রথম একজন নন-ক্রিকেটার টিমে ঢুকবে।
হ্যাঁ, আমি ওদের বুঝিয়েছি যে, আমি ক্রিকেটার না, হলেও, একজন বিশেষজ্ঞ।
লোকটা সকৌতুকে একটু চেয়ে মাথা নাড়ল।
খাওয়া শেষ করে লোকটা বলল, এবার চলো, হাতে-কলমে ব্যাপারটা দেখা যাক।
বাইরে পার্কিং লটে লোকটার ছোটো হেলি-কারে এসে উঠল তারা। এ গাড়ি মাটি দিয়ে চলে না, হুশ করে। হাওয়ায় ভেসে পড়ে। দ্রুত গতি, ব্যাটারিচালিত মোটর পাখির ডানার মতো দুটি ফ্লোটারকে চালু রাখে, পাখির মতোই স্বচ্ছন্দে ওড়ে এই গাড়ি। দশ মিনিটের মধ্যেই তারা নিরিবিলি শরতলির একটা উজ্জ্বল আলোয় সজ্জিত মাঠে এসে নামল। মাঠের মাঝখানে বাইশ গজে ক্রিকেট পিচ। চারদিকে আলোর স্তম্ভ জায়গাটাকে দিনের। অধিক আলোকিত করে রেখেছে।
লোকটা অনুচ্চ স্বরে ডাকল, রজনি?
মাঠের ধারে একটা ছোটো তাঁবুর ভেতর থেকে একটি কিশোরী মেয়ে ঘুমচোখে বেরিয়ে এসে হাই তুলল। লোকটা বলল, আমার ছোটোমেয়ে রজনি। ও যদি ছেলে হত, তবে ওকে আমার সব বিদ্যে শেখাতাম। আমার ছেলে নেই, চারটিই মেয়ে।
মেয়েরাও তো ক্রিকেট খেলে।
খেলে, আমার মেয়েরা ক্রিকেটে আগ্রহী নয়। মেয়েটা পিচের একধারে নিঃশব্দে তিনটে স্ট্যাম্প পুঁতে দিয়ে সরে দাঁড়াল, তারপর বলল, ইনিই কি তিনি?
লোকটা বলল, হ্যাঁ, আমাদের তুরুপের তাস, এসো ঢোলাকিয়া, বল করো।
রজনি একটা ব্যাগ থেকে সাদা রঙের একটা বল বের করে অরুণ ঢোলাকিয়ার দিকে ছুঁড়ে দিল। এই সেই বিতর্কিত বল নোভা, বলটাকে যদি পৃথিবী হিসেবে ধরা যায় তাহলে এর একটা সেলাই গেছে বিষুবরেখা বরাবর, অন্যটা দুই মেরু ভেদ করে, বলের দু-পিঠে এক জায়গায় সেলাই দুটো কাটাকাটি করেছে আর এই দুটো জায়গাই অরুণের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বলটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল অরুণ। নজরে পড়ল দুটো সেলাই যেখানে কাটাকাটি করেছে সেখানে হালকা পেনসিল দিয়ে চারটি অক্ষর–ডি ও এন টি, ভ্রূ কুঁচকে ঢোলাকিয়া একটু ভাবল, এর মানে কি ডোন্ট? সে মেয়েটার দিকে এক ঝলক তাকাল, মেয়েটা খুব বিরক্তি মাখানো মুখে অন্যদিকে চেয়ে আছে।
বৃদ্ধ রামনাথ রাই তার দিকে মিটমিটে চোখে লক্ষ রাখছে। রামনাথ ষাট সত্তরের দশকে ভারতীয় একাদশে খেলেছিল। তার রেকর্ড তেমন ভালো কিছু নয়, কিন্তু অরুণের মাথায় আইডিয়াটা ঢুকিয়েছিল এই লোকটাই, অঙ্কের জগতে অরুণ ঢোলাকিয়ার খ্যাতি সাংঘাতিক। বিশেষ করে জ্যামিতিক এবং ত্রিকোণমিতিক গণনায় সে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার রৈখিক গণনায় সে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার রৈখিক গণনা, বিচার ও বিশ্লেষণ পৃথিবীর যেকোনো বিষয়েই গ্রহণ করা হয়ে থাকে। বৃদ্ধ রামনাথ একদিন তার দ্বারস্থ হয়ে বলল, বাপু, ক্রিকেটের জন্য তুমি কিছু করো।
সেই সূত্রপাত, রামনাথই তাকে ক্রিকেট বুঝিয়েছিল এবং আগ্রহী করে তুলেছিল। মাসতিনেক ধরে সে নোভা বল নিয়ে মেতে আছে। আজ নিজের সাফল্য সম্পর্কে সে ঘোর আত্মবিশ্বাসী। ভারতীয় নির্বাচকমন্ডলী তার মতো নামি লোকের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে পারছে না, তাকে হয়তো দলে নেওয়া হবে। এরজন্য বৃদ্ধ। রামনাথের কাছে সে কৃতজ্ঞ। কিন্তু মুশকিল হল বলের গায়ে ডোন্ট কথাটা লিখে রজনি কী বোঝাতে চাইছে? তাহলে কি মাঠে ও আশপাশে বা ঊর্ধ্বাকাশে গুপ্তচর রয়েছে? তার বোলিং অ্যাকশন কি রেকর্ড করা হবে?
অরুণ ঢোলাকিয়া ফুটফুটে মেয়েটার দিকে বার বার তাকাল, কিন্তু মেয়েটা একবারও তার দিকে তাকাল না। উদাসীন মুখে ঘাসের ওপর বসে নিজের নখ দেখছে এখন।
ঢোলাকিয়া বিদ্যুৎবেগে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিল। বৃদ্ধ রামনাথকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না।
সুতরাং অরুণ যে ছ-টা বল করল, তার একটাও গড়িয়ে গেল না। একটাও লুপ হল না।
উত্তেজিত রামনাথ মাথা নেড়ে বলল, পিচে জায়গামতো পড়ছে না।
তাই তো দেখছি, মনে হচ্ছে শুটার বা লুপ আমাদের কাগজে-কলমেই থেকে যাবে।
রামনাথ রাই প্রচন্ড হতাশ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, তাহলে তোমার পরিশ্রম বৃথাই গেল?
তাই মনে হচ্ছে।
আবার চেষ্টা করে দ্যাখো, নোভা বলের ভেতরে এক ধরনের সিনথেটিক আঠা থাকে। তার ফলে বলটা ক্যাট বলের চেয়ে একটু বেশি লাফায়। মুশকিল কি সেখানেই হচ্ছে?
ঢোলাকিয়া জানে, সেটা সমস্যা নয়। সমস্যা রামনাথ নিজেই। অরুণ সেটা রামনাথকে বলে কী করে?
তবে সে আর এক ওভার বল করল, ইচ্ছে করে প্রথম পাঁচটা বল করল বিশ্রীভাবে। কিন্তু ষষ্ঠ বলটা করল। তার ক্ষুরধার ক্যালকুলেশন দিয়ে। বলটা নীচে পড়ে মাটি কামড়ে বুলেটের মতো ছুটে গিয়ে মিডল স্টাম্প ছিটকে দিল।
বাঃ, এই তো হচ্ছে? বলে চেঁচিয়ে উঠল রামনাথ।