হ্যাঁ, আমি প্রস্তুত।
ভালো কথা। কিন্তু এখনও আপনার বিপক্ষ গোষ্ঠী ব্যাপারটা মানতে চাইছে না।
তারা কি বার বার একটা আপত্তিই জানাচ্ছেন? নাকি নতুন কোনো পয়েন্ট বের করেছেন?
না, নতুন পয়েন্ট নয়। তারা সেই পুরোনো কথাই আরও জোর দিয়ে বলছেন, কোনো অ-খেলোয়াড়কে দলভুক্ত করা যায় না।
আমি তো বলেইছি, আমি খেলোয়াড় নই বটে, কিন্তু আমি একজন বিশেষজ্ঞ। আমার পারফরম্যান্স হবে সম্পূর্ণ ম্যাথমেটিক্যাল ক্যালকুলেশনের ওপর।
ওদের ওখানেই আপত্তি। চূড়ান্ত দলে আপনাকে জায়গা দিতে হলে একজন দক্ষ খেলোয়াড়কে বাদ দিতে হয়। যেক্ষেত্রে আমরা চাপে থাকব।
সেনবাবু, আপনাদের মানসিকতা পিছিয়ে আছে। এমন একদিন আসতে বাধ্য যখন খেলোয়াড় এবং বিশেষজ্ঞ এ-দুটোই দরকার হবে। একথা ঠিক যে আমি ক্রিকেট খুব বেশি বুঝি না, ব্যাট করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তবু আমি যা করতে পারি, তা আপনাদের টিমে কেউ পারবে না।
সেটাও পরীক্ষাসাপেক্ষ। আপনি কবে ডেমনস্ট্রেশন দিতে পারবেন?
আপনারা অর্থাৎ নির্বাচকমন্ডলীর সবাই যদি উপস্থিত থাকেন তবে আগামীকালই আমি ডেমনস্ট্রেশন দিতে পারি। কিন্তু দোহাই, একবারের বেশি দু-বার পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়।
কেন?
আমার কলাকৌশল বেশি লোকের কাছে এক্সপোজ করা ঠিক হবে না। আমি কৌশলটা একেবারে বিশ্বকাপের আসরেই প্রয়োগ করতে চাই।
খুব মুশকিলে ফেললেন।
আর একটা কথা।
কী?
আমার অ্যাকশনের কোনো ভিডিয়ো তোলা চলবে না। কোনো ক্যামেরা বা রেকর্ডারও নয়।
আপনি বড্ড বেশি দাবি করছেন।
করছি, কারণ আমি একাই ভারতকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে দেব বলে মনে করছি।
নির্বাচকরা এটাই মানতে চাইছেন না। যাই হোক, আপনি কাল সকাল দশটায় ক্রীড়াকেন্দ্রে চলে আসুন।
ফোনটা পকেটে রেখে অরুণ ঢোলাকিয়া উঠে পড়ল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে নির্জন রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল। কলকাতা শহরে আজকাল মাত্র বত্রিশ হাজার লোক বাস করে। একসময়ে এখানে এক কোটি মানুষ বাস করত। তখনও শহরটা ছিল ঘিঞ্জি, নোংরা, ভিড়াক্কার, এখন শহর গাছপালায় ভরতি। চওড়া রাস্তার দুধারে বড়ো বড়ো গাছের সারি, প্রচুর বাগান, পার্ক, জলাশয়। এসবের-ই ফাঁকে ফাঁকে অনেক দূরে দূরে একখানা করে বাড়ি।
এবার প্রচন্ড শীত পড়েছে। গতকালও দু-ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল। অরুণ ঢোলাকিয়ার গায়ে পশমের জামা আছে, তা সত্ত্বেও তার শীত করছিল। একটু হাঁটাচলা না করলে মাথার জটটা খুলবে না।
মাইলখানেক হাঁটল অরুণ, একজন মানুষের সঙ্গেও দেখা হল না। দুটো ওভারক্র্যাফট নিঃশব্দে রাস্তা দিয়ে গেল।
আঞ্চলিক বাজার নামে কথিত একটা করে বহুমুখী কেন্দ্র শহরের বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হয়েছে। এগুলো আসলে বাজার, ক্লাব, রেস্তোরাঁ ইত্যাদির সমাবেশ।
ঢুকতেই একটা হলঘর। মাঝখানে বিশাল এক ফোয়ারা, তার চারপাশে চমৎকার বসার জায়গা। দুঃখের বিষয় বসবার লোক নেই। হলঘরের মধ্যে রয়েছে বিস্তর গাছপালা এবং সবুজ লনও। ছাদটা স্বচ্ছ আবরণে তৈরি বলে এই ঘরে সূর্যের আলো আসতে পারে। হলঘরের চারদিকে ছোটো ছোটো থিয়েটার এবং ভিডিয়ো হল। টিকিট কাটতে হয় না, থিয়েটার এমনিই দেখা যায়। তবে নাটক করার মতো দল বেশি নেই বলে থিয়েটারগুলো বেশির ভাগই অচল থাকে। ভিডিয়ো হলেও লোক হয় না।
স্বয়ংক্রিয় সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় চলে এল অরুণ ঢোলাকিয়া। এখানে কিছু রেস্তোরাঁ এবং দোকানপাট। কিছু মানুষজন দেখা যাচ্ছে। তবু খুব-ই ফাঁকা। এখানেই লোকটার আসার কথা।
অরুণ চারদিকে চেয়ে সবুজদ্বীপ রেস্তোরাঁয় গিয়ে ঢুকল। খুবই ছোটো রেস্তোরাঁ। সব মিলিয়ে দশটা টেবিল পাতা আছে। খুবই কম আলোয় দেখা গেল, খদ্দের নেই বললেই হয়। একটা টেবিলে চারজনের একটি পরিবার বসে খাচ্ছে। স্বামী-স্ত্রী এবং দুটি বাচ্চা। আর কোণের দিকে একজন লোক চুপচাপ বসে আছে।
ঢোলাকিয়া সেদিকেই এগিয়ে গেল।
নমস্কার।
লোকটা মুখ তুলে একটু হাসল, বোসো ঢোলাকিয়া।
সে বলল, কী খাওয়া যায় বলো তো?
যা খুশি। তবে আমি নিরামিষাশী।
সে তো আমিও। ভেজিটেরিয়ানদের সংখ্যাই তো বেশি।
নুডলসের অর্ডার দিয়ে লোকটি পকেট থেকে একটা খুদে টেলিভিশন সেট বের করে ঢোলাকিয়ার হাতে দিয়ে বলল, ওতে চার মিনিটের একটা কভারেজ আছে দেখে নাও।
ছোটো টিভি সেটটার মধ্যেই ভিডিয়ো টেপ রয়েছে। ঢোলাকিয়া সেটটা অন করল। একটা ক্রিকেট মাঠ। একজন ব্যাটসম্যান দাঁড়িয়ে। একজন বল করতে দৌড়োচ্ছে। বল করল, পিচে পড়ে বলটা নীচু হয়ে গেল। খুব নীচু। ব্যাটসম্যান সেটাকে আটকে দিল। দ্বিতীয় বলটা নীচু হল না, কিন্তু অফস্টাম্পে পড়ে বাঁই করে ঘুরে স্টাম্পের দিকে এল। ব্যাটসম্যান বিপজ্জনক বলটাকে ফের আটকাল। দেখতে দেখতে ঢোলাকিয়া বলল, এ বল-এ আজকাল খেলা হয় না।
জানি। নতুন নোভা বলে ক্রিসক্রস সেলাই থাকে।
হ্যাঁ।
তুমি যে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে চাইছ তাতে নোভা বল হয়তো সাহায্য করবে। কিন্তু মনে রেখো, পঞ্চাশ বছর আগে পুরোনো ক্যাট বলেও এরকম সেলাই থাকত।
জানি। আমার কাছে পুরোনো সবরকম বলেরই নমুনা আছে।
পরের বলটা–আশ্চর্যের বিষয়–পিচে পড়েই সম্পূর্ণ গড়িয়ে স্টাম্পের দিকে গেল। ব্যাটসম্যান আটকাতে পারল না। বোল্ড।
লোকটা একটু হেসে বলল, দেখলে?