তারক হাঁ।
কে? কে?
আমি।
অন্ধকারেও কি আর চিনতে ভুল হয়?
তুই! তুই নরেনবাবুর সঙ্গে যাসনি?
তোমার কি মুখে কিছু আটকায় না? তার আগে গলায় দড়ি দেব।
তাহলে কোথায় ছিলি?
কোথায় আবার! বউদি লুকিয়ে রেখেছিল নতুন গোয়ালঘরে। ডাকাত যখন পড়ল তখন বেরিয়ে এসে কাণ্ড দেখে খড়ের গাদার পিছনে লুকিয়ে পড়ি। তুমি না এলে আজ কী যে হত!
নরেনবাবু তাহলে কার সঙ্গে গেল?
তার আমি কী জানি! নিয়ে যেতে চেয়েছিল বলেই তো পালিয়েছিলুম।
ও শালা মহা হারামি। একবার ভেবেছিলুম পুলিশকে বলে দিই, খুনটা ও শালাই করাচ্ছিল।
না-না, ওসব বলার দরকার নেই। আমাদের তো এ গাঁয়েই থাকতে হবে। আমরা গরিব
মানুষ।
হুঁ।
আর আমাকে বেচতে চাইবে না তো!
তারক একটু হাসল। তারপর হাত বাড়িয়ে যমুনার একটা হাত ধরে বলল , সেই তারকটা ভেগে গেছে। এখন যে–তারকের হাত ধরে হাঁটছিস সেটা একটা পরপুরুষ।
তারকের হাতে একটা জোর চিমটি কাটল যমুনা।
অধ্যাপক ঢোলাকিয়া অবশেষে এক জানুয়ারির শীতার্ত রাতে তার টেবিল ছেড়ে উঠল। টেবিলের ওপর অজস্র কাগজপত্র ছড়ানো, তাতে বিস্তর আঁকিবুকি এবং অসংখ্য অঙ্ক। এত অঙ্ক ও আঁকিবুকির সমুদ্র থেকে একটি মাত্র কাগজ তুলে নিল ঢোলাকিয়া, ভাঁজ করে কোটের বুক-পকেটে রাখল। গত সাতদিন ঢোলাকিয়া জীবন রক্ষার্থে সামান্য আহার্য গ্রহণ করা ছাড়া ভালো করে খায়নি, ভালো করে ঘুমোয়নি, বিশ্রাম নেয়নি। এখন সে একটু অবসন্ন বোধ করছিল, কিন্তু মনটা খুশিতে ভরা। মনে হচ্ছে সে কৌশলটা আবিষ্কার করতে পেরেছে।
ঢোলাকিয়াকে লোকে বলে অযান্ত্রিক মানুষ। এই কম্পিউটার এবং ক্যালকুলেটরের যুগে ঢোলাকিয়া পড়ে আছে দেড়শো বছর পেছনে। সে এখনও কাগজে কলম দিয়ে আঁক কযে, রেখাচিত্র আঁকে। পৃথিবীর যত শক্ত অঙ্ক আর রেখাচিত্র, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসেব-নিকেশ যখন যন্ত্রই করে দিচ্ছে তখন মানুষ কেন অযথা পরিশ্রম করবে? ঢোলাকিয়ার বক্তব্য হল, অঙ্ক আমার কাছে আর্ট, লাইন ড্রয়িং-এ আমি সৃষ্টিশীলতার আনন্দ পাই। যন্ত্র তো মানুষের মস্তিষ্কেরই নকল। যন্ত্র আর্ট বোঝে না, সৃষ্টিশীলতাও তার নেই। প্রোগ্রাম করা যান্ত্রিকতা আমার পথ নয়।
ঢোলাকিয়ার মতো আরও কিছু মানুষও আজকাল কম্পিউটারের চেয়ে কাগজ কলম বেশি পছন্দ করে। সংখ্যায় মুষ্টিমেয় হলেও এ-ধরনের কিছু মানুষের ইদানীং যে উদ্ভব হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। ঢোলাকিয়া তার বাড়িটাকে অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে সাজায়নি। আজকাল বোতাম টিপলেই ঘরের আকার ও আকৃতি বদলে নেওয়া যায়। কম্পিউটারে নানারকম নকশা দেওয়াই থাকে। সেসব নকশার নম্বর ধরে বিভিন্ন বোতামের সাহায্যে ওপর থেকে বা আড়াআড়ি নানাধরনের হালকা ভাঁজ করা দেওয়াল এসে ঘরকে বদলে দিতে পারে। আছে বাতাসি পর্দা, যা দিয়ে বাইরের পোকামাকড় বা বৃষ্টির ছাঁট বা ঝোড়ো হাওয়া রুখে দেওয়া যায়–জানলা বা দরজায় কপাটের দরকার হয় না। বাতাসি পর্দাকে অস্বচ্ছ করে দেওয়ারও ব্যবস্থা আছে। জানলা-দরজার প্যানেলে সরু সরু ছিদ্র দিয়ে প্রবল বায়ুর প্রবাহই হচ্ছে বাতাসি পর্দা।
ঢোলাকিয়া তার বাড়িটাকে শীততাপনিয়ন্ত্রিতও করেনি। ঠাকুরদার আমলের পুরোনো ঘরানার বাড়িতে সে যেন বিংশ শতাব্দীকে ধরে রেখেছে।
ঢোলাকিয়া আজ কিছু চঞ্চল, উন্মন। সে তার স্টাডি থেকে বেরিয়ে বাড়ির বিভিন্ন ঘরে উদভ্রান্তের মতো কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াল। নিজেকে শান্ত করা দরকার। বেশি আনন্দ বা বেশি দুঃখ কোনোটাই ভালো নয়।
ঢোলাকিয়ার বাড়িতে জনমনিয্যি নেই। এমনকী কুকুর, বেড়ালটা অবধি নয়। ঢোলাকিয়া বিয়ে করেনি, মা বাবা থাকে গাঁয়ের বাড়িতে। ঢোলাকিয়াকে সবাই অসামাজিক মানুষ বলেই মনে করে। আসলে সামাজিক হতে গেলে কাজকর্ম, ভাবনাচিন্তা এবং গবেষণার সময় অত্যন্ত কম পাওয়া যায়। সে একাই বেশ থাকে। অবশ্য সে জানে, একা বেশিদিন থাকা চলবে না। এই সোনালি দিনের আয়ু বেশি নয়। কারণ রাষ্ট্রব্যবস্থার নিয়ম অনুযায়ী বিয়ে করাটা বাধ্যতামূলক। এবং সন্তান উৎপাদনও। দু-হাজার থেকে পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, দুরারোগ্য ক্যান্সার আর এইডস, মারাত্মক ভূমিকম্প, বিশ্বযুদ্ধ ও ঘূর্ণিবাত্যায় পৃথিবীতে বিপুল লোকক্ষয়ের পরিণামে এখন জনসংখ্যা বিপজ্জনকভাবে কম। সারা ভারতবর্ষে জনসংখ্যা এখন এক কোটি তিপ্পান্ন লক্ষ মাত্র। এবং ভারতের জনসংখ্যাই পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম। চিনে আড়াই কোটি মানুষ বেঁচে-বর্তে আছে। গোটা ইউরোপে আছে দু-কোটির সামান্য বেশি। আমেরিকায় মোট পঞ্চান্ন লক্ষ। আফ্রিকায় তিন কোটি দশ লক্ষ। বিপদের কথা হল, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি বাড়ছে না। বরং কমছে। ফলে কাউকেই অবিবাহিত থাকতে দেওয়া হয় না। সন্তান উৎপাদনও করতেই হবে। কিন্তু অরুণ ঢোলাকিয়ার দুশ্চিন্তাই হল বিবাহিত জীবন। একটা মেয়ের সঙ্গে বাস করতে হবে, তার ওপর ছেলেপুলের চ্যাঁ ভ্যাঁ–এসব কি সহ্য হবে তার?
একটা কুশনের ওপর বসে কিছুক্ষণ ধ্যানস্থ হল সে। মনকে শান্ত ও সজীব রাখার এটাই প্রকৃষ্ট উপায়।
স্যাটেলাইট টেলিফোনটা সংকেত দিল। পকেট থেকে ফোনটা বের করে অরুণ ঢোলাকিয়া বলল, বলুন।
ক্রীড়া দফতর থেকে অবিনশ্বর সেন বলছি। আপনার কাজ কি শেষ হয়েছে?