তারক উঠে পড়ল। নাঃ, এতদিনে যমুনার তাহলে সুমতি হয়েছে। নরেনবাবুর সঙ্গেই যদি গিয়ে থাকে–গেছেই–তাহলে তোমার দিয়া কেল্লা। ওষুধের দোকান মানে কাঁচা পয়সা।
ঘরে ফিরে টেমি জ্বেলে বসে-বসে খানিক ভাবল তারক। খবর নিয়েছে, শ্রীপতির মাইনে মাসে তিনশো টাকা। কম কীসের? বসা চাকরি। তার ওপর উপরি তো আছেই।
মনটা বেশ ভালোই লাগছে তারকের। সে টেমি নিবিয়ে শুয়ে পড়ল। কত রাত হবে কে জানে, হঠাৎ একটা চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভাঙল তারকের। কোথা থেকে চেঁচামেচিটা আসছে তা প্রথমে ঠাহর হল না। কারও বিপদ আপদ হল নাকি?
দরজা খুলে বেরিয়ে এল তারক। মনে হল পুরো গাঁ–ই চেঁচাচ্ছে। মেয়েপুরুষের গলা শোনা যাচ্ছে।
ডাকাত! ডাকাত!
তারক লাফ দিয়ে উঠোনে নামল। তারপর নরেনবাবুর বাড়ির দিকে ছুটতে লাগল। গণ্ডগোলটা ওখানেই হচ্ছে যেন!
নরেনবাবুদের পুরোনো ভাঙা বাড়ি সারিয়ে দালান তুলে দিয়েছে নিতাই রায়। বেশ বড়সড়ো বাড়ি। উঠোনে ধানের মরাই, টিপকল, পিছনে গোয়াল, পেঁকিঘর। বাড়িটা হাতের তেলোর মতোই চেনে তারক।
চেঁচালেও পাড়ার লোক কেউ বেরোয়নি ভয়ে। বাইরের উঠোনে মশাল হাতে কালিঝুলি মাখা একটা লোক দাঁড়িয়ে। হাতে একখানা বড়সড় ছোরা চকচক করছে। আর ভাঙা দরজা দিয়ে আর দুজন টেনে হিঁচড়ে বাইরে বের করে আনছে নরেনবাবুর বোবা–কালা বউটাকে। বউটার শাড়ি খুলে লম্বা হয়ে ছড়িয়ে গেছে ঘর অবধি। তার মুখে কথা নেই, কেবল আঁ–আঁ চিৎকার।
তারক চেঁচিয়ে বলল , ডাকাতি করছ করো, বউটাকে ওরকম করছ কেন হে? অ্যাাঁ, ওকে ছেড়ে দাও। বোবা–কালা মানুষ।
উঠোনের ছোরা হাতে লোকটা একবার তার দিকে ফিরে দেখে একটা হাঁক মারল, ভাগ শালা শুয়োরের বাচ্চা। পেট ফাঁসিয়ে দেব…
তারক থমকে গেল। হচ্ছেটা কী? ডাকাতি করবি কর। কিন্তু মেয়েছেলেটাকে টেনে বের করছিস কেন? অবোলা মানুষ।
হঠাৎ ঝাঁক করে মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেল তারকের। এ শালারা ভাড়াটে খুনে নয় তো?
চুলের মুঠি ধরে হেঁচড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে আনছে মলয়াকে। একজন খেটে মোটা একটা লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে অমানুষিক জোরে। হাড়গোড় ভেঙে যাওয়ার কথা।
আঁ-আঁ-আঁ-আঁ চিৎকারটা চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে সাইরেনের মতো। সেই চিৎকারে মড়া মানুষও শিউরে উঠবে। মশালের আলোয় তারক দেখতে পেল, মলয়ার মুখ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে।
উঠোনের লোকটা ছোরা হাতে এগিয়ে যাচ্ছিল মলয়ার দিকে।
তারক জন্মে মারদাঙ্গা করেনি। সে ভিতু মানুষ। কিন্তু আজ মাথাটা যেন বড্ড তেতে গেল হঠাৎ। চারদিকে ঢেলা আর ইটের অভাব নেই। পুরোনো বাড়ির ভাঙা টুকরো চারদিকে ছড়ানো। তারক একখান ইটের টুকরো তুলে খানিক দৌড় দিয়ে টিপ করে মারল। একটা, দুটো, তিনটে…
মার শালাকে! মার শালাকে…বলে চেঁচাচ্ছিল তারক।
তার পয়লা ইটেই ছোরাওলা মাথা চেপে বসে পড়েছিল। আর ইটগুলো লাগল কি না কে জানে, তবে তোকগুলো ভড়কে ছিটকে গেল এদিক-ওদিক। তারক লাফ দিয়ে গিয়ে উঠোনে ঢুকল।
সামনে একটা ঘেঁটে লাঠি পড়েছিল। সেইটে তুলে নিল সে। তারপর বসা ডাকাতটা উঠতে যেতেই পাগলের মতো মারতে লাগল তাকে।
কে একজন চেঁচাল, পালা–পালা…লোক আসছে…
ডাকাতের জান বলে কথা। অত পিটুনি খেয়েও লোকটা হঠাৎ উঠে প্রাণভয়ে দৌড় লাগাল। কে কোথায় গেল কে জানে। তবে মেয়েটা বেঁচে গেল এ যাত্রা।
গাঁয়ের লোক বোধহয় তারকের সাহস দেখেই বেরিয়ে এল এতক্ষণে। লহমায় লাঠিসোঁটাধারী পুরুষ আর মেয়েছেলেতে উঠোন ভরতি। মেয়েদের কারও হাতে বঁটি অবধি। চেঁচামেচিতে কান পাতা দায়।
মলয়াকে ধরে তুলতে হল। বোবা মেয়েটা থরথর করে কাঁপছে, চোখে ভূতুড়ে দৃষ্টি। সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারছে না। তারক পাঁজাকোলে করে তাকে ঘরে এনে শোওয়াল বিছানায়। মেয়ে দুটো চেঁচিয়ে কাঁদছে।
নরেনবাবু কোথায়? নরেনবাবু কি খাটের নীচে নাকি? নাকি পালিয়ে গেছেন? এসব নানা জন জিগ্যেস করতে লাগল।
একজন মুনিশ এগিয়ে এসে বলল , বাবু আজ সাতসকালেই একটু শহরে গেছেন। আজ ফিরবেন না।
তারকের গা জ্বালা করছিল হঠাৎ। নরেনশালাই মলয়াকে খুন করতে লোক লাগায়নি তো। শালার যে যমুনার ওপর দারুণ লোভ। তারকের কাছে বিয়ের প্রস্তাব অবধি দিয়ে রেখেছে।
মাথাটা বড্ড গরম হচ্ছিল তারকের। সবাই এসে পিঠ চাপড়ে যত তার বীরত্বের প্রশংসা করছিল আর ততই তারকের গায়ের রোঁয়া দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল রাগে। ব্যাপারটা তার কাছে। পরিষ্কার। ডাকাতি নয়, ডাকাতরা অকারণে খুন করে না। এরা খুন করতেই এসেছিল।
তপন হালদারের ছেলে মিতুল মোটরবাইকে করে কালীপুর থেকে মন্মথ ডাক্তারকে নিয়ে এল। গাঁয়ে হোমিওপ্যাথি জগন্নাথ কী সব ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিল মলয়াকে। যাই হোক বউটার চোট তেমন মাত্রাছাড়া নয়। মন্মথ ডাক্তার দেখেটেখে বলল , হাড়–টাড় ভাঙেনি। তবে ভোগান্তি আছে।
তারক ভিড়ের বাইরে উঠোনের এক ধারে এসে দাঁড়িয়ে ওপরে চেয়ে আকাশটা দেখল। সে অমানুষ ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও ঢের অমানুষ তো পৃথিবীতে আছে দেখা যাচ্ছে।
কালীপুর থানা থেকে পুলিশও এসে পড়ল জিপে করে। জবানবন্দি দিতে দিতে রাত প্রায় ভোর। তারপর তার বাড়িমুখো রওনা হল। মনটা খারাপ লাগছে। বউটা এঁটো হয়ে পড়ল!
বাঁশঝাড় পেরনোর সময়ে কে যেন বলে উঠল, আমি তো জানতুম তুমি খারাপ লোক নও।